রাত সাড়ে ১০টার মতো হবে। গ্রামের বৃক্ষশোভিত পথ। সংকীর্ণ পাকা রাস্তা। রাস্তার দুধারে লাইটপোস্ট নেই বলে ঘন অন্ধকার। আকাশে চাঁদ থাকলে এতটা অন্ধকার হতো না। গ্রামে অটোরিকশা, মোটরবাইকের চলাচল ৯টার পরেই বন্ধ হয়ে যায়। যানবাহনহীন নির্জন পথটা কালো সাপের মতো শুয়ে আছে চুপচাপ।
সেই রাস্তার নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার ছিঁড়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিছিলেন থানার ওসি আরমান খন্দকার। সবাই তাকে ওসি আরমান বলে। সহযাত্রী হিসেবে তার মোটরবাইকের পেছনে বসেছিলেন তার সহকর্মী এসআই খবির। তারা বিরামপুর বাজারের দিকে আসছিলেন। অবশ্য থানায় যাওয়ার জন্য বাজারের আগেই ডান দিক দিয়ে একটা পথ বেরিয়ে গেছে। হয়তো তারা চা খেতে আসছিলেন। বিরামপুর বাজারে রাত সাড়ে ১০টা/১১টা পর্যন্ত চা পাওয়া যায়। আর এখানে রশীদ মিয়ার চায়ের সুনামও আছে। সেই সঙ্গে সবাই জানে ওসি আরমানের বেপোরোয়া চায়ের নেশার কথা।
ওসি আরমান আর এসআই খবির গিয়েছিলেন শালপাতা গ্রামে সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে। রাত ৯টার ভেতর তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। ওসি আরমান গল্পবাজ মানুষ। খাওয়ার পর গল্পসল্পে কেটে গেছে ঘণ্টাখানেক।
বাজারের ঠিক আগে আসতেই আচানক গাছের আড়াল থেকে কে যেন টালমাটাল পায়ে রাস্তায় বের হয়ে এল। সে গান গাইছে-
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে
আমার পৃথিবী থেকে
আলোর পথে আর কেউ নেবে না
আমারে কখনো ডেকে।
ওসি আরমান আপ্রাণ চেষ্টায় দুর্ঘটনা এড়ালেন। আর একটু হলে মোটরবাইক নিয়ে পাশের খাদে চলে গিয়েছিলেন। বাইশ বছর ধরে মোটরবাইক চালাচ্ছেন। দক্ষ চালক বলেই সামলে নিতে পারলেন।
এসআই খবির ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। লাঠি হাতে তেড়ে গেলেন টালমাটাল পায়ের যুবকের দিকে। ওসি আরমান তাকে নিরস্ত করলেন। বোঝা যাচ্ছে যুবকটা মাতাল। বর্তমানে তাড়িমদ খুব সহজ হয়ে গেছে। অন্যসব রকম মাদক ঠেকানো গেলেও তাড়িমদ ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ এগুলো বাড়িতেই তৈরি করা যায়। আর এ ধরনের মদ একটু বেশি খেলেই মদখোর বেশামাল হয়ে পড়ে।
যুবকটা বলল- ওসি সাহেব, আমার নাম মনোয়ার হাসান। সবাই হাসান নামে চেনে। এই যে বাজারের লাগোয়া আমাদের বাড়ি। ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার্স শেষ করেছি এবার।
সবাই তাকে হাসান নামে চিনলেও ওসি আরমান বা এসআই খবির তাকে চিনতে পারলেন না। তাদের চেনার কথাও না। ওসি আরমান বললেন- আপনি এভাবে অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছেন যে? আর একটু হলেই তো আমি দুর্ঘটনায় পড়তাম। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি।
ওসি আরমানের এ কথায় কান না দিয়ে হাসান বলল- মিলুর বিয়ের দাওয়াত থেকে এলেন ওসি সাহেব?
সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ের নাম মিলু ওসি আরমান তা জানে। ওসি আরমান কিছু বলার আগেই এসআই কবির বললেন- আপনি তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। জানেন, আপনাকে আমরা এখন থানায় নিয়ে যেতে পারি?
-নিয়ে যান। আমাকে বেঁধে থানায় নিয়ে যান। কঠিন একটা মামলা দিয়ে আমাকে জেলে আটকে রাখেন। খুনের আসামি করে ফাঁসি দিতে পারলে আরও ভালো হয়। মানুষের জগৎ আমার আর ভালো লাগে না। মানুষের এই জগতে আছে শুধু স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস। এখানে প্রেমের নামে চলে সাপলুডু খেলা। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারবেন?
মাতাল হলে লোকে নানারকম ভাবের কথা বলে। চাকরিসূত্রে ওসি আরমান আর এসআই খবিরের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে। হাসান ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার্স।
সে কেন তাড়িমদ খেয়ে এরকম মাতলামি করছে? এ গ্রামে এরকম শিক্ষিত তো খুব বেশি নেই। ওসি আরমান বললেন- হাসান সাহেব বাজারে আসেন। চা খেতে খেতে আপনার সঙ্গে কথা বলব।
-কী বিষয়ে কথা বলবেন?
-কথা বলার বিষয় পাওয়া যাবে।
-মিলুদের সঙ্গে কি আপনার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে?
-না, তা নেই।
-তাহলে বিয়েতে দাওয়াত দিল যে? থানার ওসি, এসআইদের তো দাওয়াত দেয় যারা এলাকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা। মিলুর বাপ সিদ্দিক ব্যাপারী তো সেরকম কেউ নন।
-আমাকে দাওয়াত দেওয়ার কারণটা ভিন্ন।
-কী কারণ?
-আমি তিনবার এই মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। চতুর্থবারের মাথায় তার বিয়ে সম্পন্ন হলো। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বড় চাকরি করে। তো তারা আমার কাছে কৃতজ্ঞ। আগে যেসব ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারা এরকম যোগ্য ছিল না। তাদের স্ট্যাটাস অনেক নিচে ছিল।
-চলেন বাজারে যাই। বাজারে গিয়ে চা খেতে খেতে কথা বলি।
ওসি আরমান বাইক টান দিয়ে রশিদ মিয়ার চায়ের দোকানে গেল। শত হলেও থানার ওসি। গ্রামের মানুষের কাছে ভয়ের এবং সম্মানের ব্যক্তি। উপস্থিত লোকজন দ্রুত সরে গিয়ে পুরো একটা বেঞ্চি খালি করে দিল। রশিদ মিয়া বলল- স্যার, কী চা খাইবেন, দুধ চা না লাল চা? দুধ চায়ে খাঁটি
গরুর দুধ দিই। লাল চা যদি খান তো লেবু, আদা, পুদিনা পাতা আছে।
ওসি আরমান বললেন- একটু পরে, হাসান আসুক।
এ কথা শুনে উপস্থিত লোকদের চোখে-মুখে বিস্ময় জাগল। হাসানকে তারা সবাই চেনে। হাসানের সঙ্গে যে ওসি সাহেবের খাতির আছে তা কেউ জানত না।
মিনিট সাতেকের মধ্যে হাসান এল। তার টালমাটাল অবস্থা কমেনি। হাসান এত রাতে তাড়িমদ খেয়ে হাঁটছে এ ব্যাপারটাও উপস্থিত লোকদের বিস্ময়ের কারণ হলো। শিক্ষিত-ভদ্র যুবক হিসেবেই তাকে সবাই চেনে। এলাকার অনেকের ছেলেমেয়েকে সে গণিত প্রাইভেট পড়ায়। সে তাড়িমদ খাবে একথা কেউ কল্পনাও করেনি। ওসি আরমান সরে গিয়ে হাসানকে বসতে দিলেন। হাসান বসলে ওসি আরমান বললেন- আমাদের তিনজনকে লাল চা দিন।
লাল চায়ে চুমুক দিয়ে হাসান বলল- ওসি সাহেব, মূলত আপনি মিলুর বিয়ে ভাঙেননি। তিনবারই মিলুর বিয়ে ভেঙেছি আমি। সবাই ঝট করে তাকাল হাসানের মুখে। ভাবল, তাড়ির মাদকতায়ই হয়তো সে এমন কথা বলছে। তবে কণ্ঠ জড়ানো নয়, স্পষ্ট ও স্বাভাবিক।
হাসান আবার বলল- ওসি সাহেব, তিনবারই কিন্তু ফোন গিয়েছিল যে, এই ঠিকানায় একটি বাল্যবিবাহ হতে যাচ্ছে। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। বিয়ে হলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। জাতি বঞ্চিত হবে একটি শিক্ষিত মা থেকে।
ওসি আরমান বললেন- হু, তিনবারই ফোন পেয়ে আমি ফোর্স নিয়ে ছুটে এসেছিলাম। বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।
-ফোনগুলো কে করেছিল?
-দিন-তারিখ দিয়ে সব রেকর্ড করা আছে। দরকার হলে বের করতে পারব। দরকার বোধ করিনি।
-ফোনগুলো করেছিলাম আমি। তবে এবার আর পারলাম না। এবার সে প্রাপ্তবয়স্ক। অনার্স ফোর্থ সেমিস্টারে পড়ে। নিজের জীবন নিজেরই বোঝার সক্ষমতা রয়েছে। আমার ফোনে কোনো লাভ হতো না। থানা-পুলিশ আমার ফোনকে বিশেষ গুরুত্ব দিত না।
ওসি আরমান বিষয়টা বুঝতে পারলেন। উপস্থিত অন্যরাও বুঝতে পারল। একটা ভালোবাসার নির্মম সমাপ্তি ঘটেছে। কেউ কিছু বলছিল না। কী আর বলবে? বলার মধ্যে হাসানকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলা যায়। এসব ক্ষেত্রে সান্ত্বনা খুব একটা কাজে আসে না। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। যুবকটা তাড়িমদ খেয়ে অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতটা কষ্ট তার বুকে বাজছে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।
হাসান লম্বা একটা চা শেষ করে কাপটা নিঃশেষ করে কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে বলল- অথচ মিলু বলেছিল, এতদিন তুমি আমার বিয়ে ভেঙেছ। এখন আর তোমাকে এই ঝুঁকিতে যেতে হবে না। বাবা যদি আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে তো আমিই ভেঙে দিতে পারব। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স আমার হয়েছে। তুমি ভারমুক্ত থাক, এবার একটা চাকরি জোগার কর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কী করল আমার জন্য? কথা কি রাখল?
কেউ কিছু বলল না। প্রেম-বিরহের গল্পগুলো সাধারণত একই রকম হয়। যার কষ্ট সে-ই শুধু বোঝে। একটু থেমে হাসান আবার বলল- মাত্র চার দিন আগেও মিলু আমার পাশাপাশি বসেছিল। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনেক কথা বলল। ঘুণাক্ষরেও আমি বুঝতে পারলাম না যে, মাত্র চার দিন পরই মিলু আরেকজনের বাসর আলোকিত করতে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য বলেন ওসি সাহেব!
ওসি আরমান পকেট থেকে একটা কয়েন বের করলেন। কয়েনটা দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে বললেন- এই যে কয়েন। কয়েনের দুটা দিক আছে। একটা হেড আরেকটা টেল। এর বেশি কিছু নেই। প্রেমেরও তাই। প্রেমে হয় বিরহ, নয় মিলন। জ্ঞানীরা বলেন, প্রেম বিরহেই অধিক উজ্জ্বল। বিরহেই প্রেমের সৌন্দর্য চির অমলিন। মিস্টার হাসান, মিলু আপনার হৃদয়ে চির অমলিন হয়ে থাকবে। শত চেষ্টা করলেও আপনি তাকে হৃদয় থেকে মুছতে পারবেন না। সে চলে গেছে অন্যের অধিকারে, তাই বলে আপনি কিন্তু তাকে ঘৃণাও করতে পারবেন না। সে আপনার চিরন্তন ভালোবাসা। ঠিক মিলুর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে যত সুখ আর প্রাচুর্যের মধ্যেই সে থাক, তার মনের মণিকোঠায় আপনার জন্য একটু জায়গা শূন্য থাকবেই। কেউ সে শূন্যতা ভরাট করতে পারবে না।
হাসান মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ওসি আরমান বললেন- হাসান সাহেব, আমি তাহলে...।
হাসান মাথা তুলল। সবাই দেখল হাসান কাঁদছে। পুরুষ মানুষের নিঃশব্দ কান্নার ভেতর কতটা কষ্ট লুকিয়ে থাকে তা পুরুষমাত্রই উপলব্ধি করতে পারে। ওসি আরমান হাসানের কাঁধে, পিঠে হাত রাখলেন, আলত আঘাত করলেন, তারপর উঠে গেলেন।
চায়ের দোকানের লোকজন চলে গেল। দোকানদার মজনু মিয়া বলল- হাসান ভাই, বসেন। দোকান বন্ধ করে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাব।
দোকান বন্ধ করতে করতে মজনু মিয়া বলতে লাগল- ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছও আবার নতুন করে বাঁচার জন্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। নতুন ডাল হয়। নতুন পাতা গজায়। ফুল ফোটায়। ফল ফলায়। এরকম কষ্ট অনেকের জীবনেই আছে। এই যে সারা দিন আমার সামনে চায়ের কেটলিতে পানি ফোটে, একটা কষ্ট আমার ভেতরও ফুটতে থাকে অবিরত। কেউ বোঝে না। বুঝে কী করবে বলেন? এই কষ্টের আগুনে এতটুকু পানি দেওয়ার সাধ্য তো কারও নেই। আমি চা বানায়া মানুষকে খাওয়াই। হেসে হেসে কথা বলি। আনন্দ করি। কিন্তু ভেতরে হৃদয়টা প্রায়ই হাহাকার করে ওঠে। চলেন হাসান ভাই, চলেন যাই।
হাসান উঠে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা ভরাট কণ্ঠে গেয়ে উঠল-
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে
আমার পৃথিবী থেকে...