![উমরায় ১০ নির্দেশনা মেনে চলুন](uploads/2023/12/21/1703130001.21-december-UG-02.jpg)
সেলফি, ভিডিও এবং ইন্টারনেটের অপব্যবহার
অনেকে জেনে কিংবা না জেনে উমরায় গিয়ে মক্কা-মদিনার স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন জায়গার ছবি কিংবা সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভিডিও করেন। ভিডিওকলে পরিচিতজনদের কাবাঘর ও মসজিদে নববি দেখান। ইন্টারনেটের অপব্যবহার করেন। সেখানে অবস্থানকালে টুইটার, ফেসবুক, ইনষ্ট্রাগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ছবি আপলোড দিয়ে কুড়াতে চান লাইক আর কমেন্টের প্রশংসা। রিয়া বা লৌকিকতাপূর্ণ এসব কাজ আমাদের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটায়, আন্তরিকতা নষ্ট করে। তাই হাদিসে এমন কাজকে শিরকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) অহংকারমুক্ত হজ পালনের জন্য বিদায় হজে দোয়া করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার হজকে রিয়া ও খ্যাতির আকাঙ্ক্ষামুক্ত হজ হিসেবে কবুল করুন।’ (ইবনে মাজাহ, ২৭৯০)
প্রয়োজনীয় খরচে কার্পণ্য করবেন না
কৃপণতা সব সময়ের জন্য নিন্দনীয় স্বভাব। বিশেষ করে হজ-উমরার সফরে। আয়েশা (রা.)-কে তার উমরার সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘(উমরার এ সফরে) তুমি যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করবে ও অর্থ ব্যয় করবে; সে অনুযায়ী আল্লাহতায়ালা তোমাকে প্রতিদান ও সওয়াব দান করবেন।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, ১৭৩৩) অতএব প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে একেবারে হাত গুটিয়ে না রেখে সাধ্যমতো খরচ করুন।
রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, গুনাহমুক্ত থাকুন
সব সময় রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করুন। বিশেষ করে উমরার দিনগুলোয় রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। রাগ নিয়ন্ত্রণে অনেক গুনাহ থেকে বাঁচা যায়। কারণ রাগ গুনাহ ডেকে আনে। গুনাহ উমরার ক্ষতি করে। রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, গুনাহমুক্ত থাকুন।
সময় নষ্ট করবেন না
মক্কা-মদিনায় অবস্থানের দিনগুলো অযত্ন আর অবহেলায় পার করবেন না। আমল-ইবাদত বাদ দিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যতটুকু সময় পান আল্লাহর জন্য ব্যয় করুন। বেশি বেশি তওবা করুন। নিজের জন্য, পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করুন। নামাজ, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত ও নফল ইবাদতে সময় অতিবাহিত করুন।
একাধিক উমরা করতে চাইলে
কেউ কেউ একবার উমরা আদায়ের পর পুনরায় উমরা আদায়ের লক্ষ্যে তানয়িমে অবস্থিত মসজিদে আয়েশা থেকে ইহরাম করে একাধিক উমরা আদায় করেন। অথচ এক সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিদের থেকে একাধিক উমরা করার কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তাই অনেক আলিমের মতে নফল উমরার চেয়ে নফল তাওয়াফ অধিক উত্তম। এজন্য এভাবে নফল উমরা না করে তাওয়াফ বেশি করা কাম্য।
মক্কায় থাকাবস্থায় ইচ্ছা করলে নফল উমরাও করতে পারেন। উমরার নিয়ত নিজেই করবেন, নিজেই পালন করবেন। তবে বলবেন, ‘হে আল্লাহ, এই উমরাটি আপনি কবুল করুন। এর সওয়াব আমার পিতাকে দান করুন।’ স্বাস্থ্য ভালো থাকলে একাধিক উমরা করতে পারেন। এর জন্য মিকাতের বাইরে যেতে হবে। মক্কার নিকটাবর্তী মিকাত হলো মসজিদে আয়েশা। জেদ্দা, মদিনা ও তায়েফের দিকে গেলেও মিকাত আছে। প্রতিটি নফল উমরা করে জীবিত বা মৃত আত্মীয়স্বজনের জন্য দোয়া করা। ব্যক্তি সমাজ ও দেশের জন্য দোয়া করা কর্তব্য।
আমলে ভিন্নতা দেখে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই
মক্কা-মদিনায় নামাজ, উমরা প্রভৃতি আমলের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ভিন্নতা দেখতে পাবেন। এতে বিচলিত কিংবা বিভ্রান্ত হবেন না। এ নিয়ে কারও সঙ্গে বিতর্কেও জড়ানো যাবে না। এসব ক্ষেত্রে দেশের যে আলেমের ইলম ও তাকওয়ার প্রতি আপনার আস্থা রয়েছে, তার কাছ থেকে সমাধান জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী আমল করবেন। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে হানাফি মাজহাব অনুসরণে যে আমল করা হয়ে থাকে, তার স্বপক্ষেও কোরআন-সুন্নাহর মজবুত দলিল রয়েছে। এমনিভাবে হানাফি মাজহাবসহ স্বীকৃত চারটি মাজহাবের কোনোটিই কোরআন-সুন্নাহ থেকে ভিন্ন কোনো বিষয় নয়। মক্কা-মদিনায় হজ ও উমরা করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে চারও মাজহাবের লোকজন আসেন। তাদের সবারই নামাজের আলাদা পদ্ধতি রয়েছে; তা দেখে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত ও জানাজার নামাজে পদ্ধতিগত যে দু চারটি ভিন্নতা চোখে পড়ে তাও সুন্নাহসম্মত এবং তারও মূল ভিত্তি সুন্নাহ। আর আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করা হয় তারও ভিত্তি সুন্নাহ। উভয় পদ্ধতিই সুন্নাহ ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এজন্য সেখানে কোনো ভিন্ন পদ্ধতি দেখে নিজ দেশের আলেমদের প্রতি অনাস্থা নিয়ে আসবেন না। এছাড়া মাতাফে নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে সকলের জন্য অতিক্রম করা জায়েজ। আর মাসজিদুল হারামেও প্রয়োজনে নামাজির সামনে দিয়ে তাওয়াফকারীদের চলাচল করা জায়েজ। (ইবনে হিব্বান, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ১২৮)
জুমার নামাজ
হাম্বলি মাজহাবে এক মত অনুসারে, জাওয়ালের (জোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়া) আগেই জুমার ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। সম্ভবত এ কারণেই হারাম শরিফে জাওয়ালের বেশ আগেই জুমার প্রথম আজান হয়ে যায়। আবার জোহরের ওয়াক্ত শুরু হবার পরপরই জুমার দ্বিতীয় আজান দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খুতবা শুরু হয়ে যায়। ফলে ওয়াক্ত হওয়ার পর জুমার সুন্নত আদায়ের সুযোগ পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে দুটি কথা-ক. হারামা শরিফে জুমার প্রথম আজানের পর আপনি তাহিয়্যাতুল মসজিদ-সহ বিভিন্ন নফল নামাজ পড়তে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন মাকরুহ ওয়াক্তে (জাওয়ালের সময়) নামাজ পড়া না হয়। খ. আর জুমার পূর্ববর্তী সুন্নত ফরজের পর আদায় করে নেবেন। (কিফায়াতুল মুগতাজি, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ২৪৮)
জানাজার নামাজ
মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববিতে প্রায় প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর জানাজা নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আপনিও জানাজার নামাজে অবশ্যই শরিক হবেন। সেখানে ইমাম সাহেব শুধু একদিকে সালাম ফিরিয়ে জানাজা শেষ করে থাকেন। তো এক্ষেত্রে দুটো কথা মনে রাখুন—জানাজার নামাজে দুদিকে সালাম ফেরানো কিংবা একদিকে সালাম ফেরানো—দুটিই হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। যেহেতু উভয় আমলই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, অতএব আপনি দুই দিকে সালাম ফিরাতে পারেন। আবার ইমামের অনুসরণে একদিকে সালাম ফিরিয়েও জানাজা শেষ করতে পারেন। (ফায়জুল বারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪৫৭)
এবার দেশে ফেরার পালা
উমরা শেষ হলে দেশে ফেরার আগে চারটি কাজ করুন। প্রথমত, আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করুন। দ্বিতীয়ত, উমরার আমলগুলো কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। তৃতীয়ত, হারামাইনে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে হওয়া ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। চতুর্থত, হারামাইনের সংস্পর্শে এসে যে নেক আমলের অভ্যাস তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখার সংকল্প ও চেষ্টা করুন।চারটি কাজ শেষে দেশে ফেরার যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করুন। ব্যাগ-লাগেজে প্রয়োজনীয় মালপত্র গুছিয়ে নেন। সময়মতো বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।
উমরা থেকে ফিরে
সফর থেকে ফিরে এসে উমরার শিক্ষাকে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাহলেই এ বরকতময় সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জিত হবে এবং তা গোটা জীবনের জন্য আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করবে।
মনে রাখবেন, এ প্রত্যাবর্তন সাধারণ কোনো সফর থেকে নয়; বরং আল্লাহর ঘর জিয়ারত করে ফিরে আসা। এ সম্মান রক্ষার্থে জিয়ারতকারীর ওপর আরোপিত হয়ে গিয়েছে বহুবিধ দায়িত্ব-কর্তব্য।
লেখক: মুহতামিম (প্রশাসন), জামিয়া ইকরা বাংলাদেশ, রামপুরা