![রাস্তায় দাঁড়িয়েই ইফতার](uploads/2024/03/31/1711860962.traffic-istar.jpg)
একদিকে শৌচাগার সংকট, অন্যদিকে নেই ভালো ট্রাফিক বক্স। হাত মুখ ধোয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেই। তীব্র রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, ধোঁয়া, ধুলোবালি, উচ্চ শব্দ ট্রাফিক পুলিশের নিত্যসঙ্গী। পবিত্র রমজান মাসে কষ্ট আরও বেশি। রোজা রেখে দিনভর প্রচণ্ড রোদে রাজধানীর পথে পথে দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। ইফতারের পর্ব সেরে নিতে হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। একই সঙ্গে চলে যানবাহনের চাপ ও গতি সামলানোর গুরুদায়িত্ব।
নগরবাসী যাতে সঠিক সময়ে বাসায় বা গন্তব্যে পৌঁছে স্বজন-পরিবারের সঙ্গে ইফতারি করতে পারেন, সেজন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় তাদের। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ইফতারি করার সুযোগ হয়ে ওঠে না তাদের। নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে সড়কেই ইফতারি সেরে নিতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। রাস্তায় যানবাহনের চাপ সামলানোর কারণে কয়েক মিনিট বসার সুযোগও মেলে না। তাই দাঁড়িয়েই ট্রাফিক পুলিশদের করতে হয় ইফতারি। কথাগুলো বলছিলেন বাংলামোটরে ইফতারের সময় ডিউটিরত ট্রাফিক পুলিশ মুজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, রাজধানীর সড়কে সড়কে আমার মতো অনেক ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়েই ইফতার করেন। তবে এসব আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। শনিবার (৩০ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক পুলিশের ইফতারের এমন চিত্র চোখে পড়ে।
বাংলামোটর পুলিশ বক্সে ট্রাফিক পুলিশের ৫ জন সদস্য ডিউটি করেন। তারা হলেন মো. মাসুদ, বিপ্লব, মুজিবুর ও ট্রাফিক সার্জেন্ট মাসুদুর রহমান মাসুদ। তারা খবরের কাগজকে জানান, সাধারণ মানুষ যাতে নিরাপদে ঘরে গিয়ে পরিবার পরিজনদের সঙ্গে ইফতারি করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমরা সব সময় কাজ করি। ইফতারের আগ মুহূর্তে আমরা অনেক সময় পানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকি, আজান দেওয়ার পর ইফতারি সেরে নিই। কারণ আমাদের কাছে দায়িত্বটা অনেক বড় বিষয়।
রমনা বিভাগের পুলিশ ভবন ক্রসিংয়ের সামনে ইফতারের মুহূর্তে কথা হয় ট্রাফিক সার্জেন্ট রেজাউল রেজার সঙ্গে। তিনি বলেন, ইফতারের সময় আমরা রাস্তা ভাগ করে নিয়ে কাজ করি। অনেক সময় সবাইকে দাঁড়িয়েই ইফতারি করতে হয়। কিছু কিছু সময় ট্রাফিক সদস্যদের পুলিশ বক্সে পাঠিয়ে দিয়ে আমিসহ দু-একজন রাস্তায় দাঁড়িয়েই ইফতারি করি।
প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইফতারি করেন, খারাপ লাগে কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের চাকরি করতে এসেছি, সেবা করার লক্ষ্যে। কাজেই মানুষের সেবাটা আগে দেখতে হয়। তবে কিছু কিছু সময় পরিবার থেকে যখন ফোন করে জানতে চায়, তখন মন খারাপ লাগাটা খুবই স্বাভাবিক।
রমনা জোনের অফিসার্স কোয়ার্টার মোড়ে ডিউটিরত অবস্থায় পানি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ট্রাফিকের সার্জেন্ট আরিফ মো. রায়হান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো মানুষকে ইফতারের সময় তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। সেজন্য ট্রফিক পুলিশ কাজ করে থাকে। শনিবার বলে যানজট কিছুটা কম। ট্রাফিক সদস্যদের পুলিশ বক্সে পাঠিয়ে দিয়ে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। আজানের সময় পানি পান করব। ৫ মিনিট পরে ট্রাফিক কনস্টেবল সুজাত উল্লাহ সুজা, কামাল ও মো. রাজিব চলে এলেই আমি বক্সে যাব। ইফতারি করে আবারও রাস্তায় এসে দাঁড়াব, কারণ ইফতারির পর রাস্তায় একটু যানজট বেড়ে যায়। সেটা সামলাতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ট্রাফিক পুলিশের ইফতারি, আর কাজ চলে এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে। একদিকে যানজট নিরসনের দায়িত্ব, অন্যদিকে ইফতারি! এটাই ট্রাফিক পুলিশের জীবন। সব মিলিয়ে সেবাটাকেই বড় করে দেখি আমরা।
ইফতারের কিছুক্ষণ আগে কারওয়ান বাজারের মোড় ক্রসিংয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে দেখা যায় ১৫ জনের একটি টিম। তারা সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন নিরলসভাবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তাদের মধ্যে কয়েকজন ইফতারি প্রস্তুত করছিলেন। দ্রুত মুড়ি, ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজুসহ অন্যান্য খাবার মেশানো শেষে শরবত ও পানির কয়েকটি বোতল পৌঁছে দেওয়া হয় রাস্তায় যারা সিগন্যালে ডিউটি করছেন, তাদের হাতে। প্লাস্টিকের গামলায় করে সব খাবারের আইটেম নিয়ে আসা হলো। ইফতারের সময় জড়ো হয়ে তারা ইফতারি সেরে নিলেন পথেই।
সরকারিভাবে ইফতারে তাদের একেক জনের জন্য একটি বেগুনি, একটি পেঁয়াজু, খেজুর সঙ্গে কিছু ছোলা আর মুড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। অবশ্য নিজেদের উদ্যোগে আরও বেশ কয়েকটি ইফতারির আইটেম যুক্ত করে থাকেন তারা। বাংলামোটর ট্রাফিক বক্সের টিআই কবির হোসেন বলেন, ডিএমপি থেকে মাথাপিছু ১টি করে ইফতারের প্যাকেট বুঝিয়ে দেওয়া হয় দায়িত্বরত ট্রাফিক বক্সের কর্মকর্তাদের কাছে।
কারওয়ান বাজার ট্রাফিক সিগন্যালে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে মিনিটে কয়েকবার দৌড়ে একেক দিকে ছুটতে হয়। এ জন্য ইফতারের প্যাকেট কাছেই রাখি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ইফতারের সময়ও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন। নগরবাসী বাসায় ইফতার করার জন্য দ্রুতগতিতে ছোটেন। কিন্তু আমাদের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকেন, যাতে সবাই স্বস্তিতে বাসায় গিয়ে পরিবার নিয়ে ইফতার করতে পারেন। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অনেক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়েই ইফতারি করতে হয়। দেখা গেছে, তারা এক হাতে পানির বোতল নিয়ে ইফতারি করেন এবং অন্য হাতে সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি চলাচলব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখেন।
ডিএমপির ট্রাফিক প্রধান মো. মুনিবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা যেভাবে ইফতারি করেন, এটা আসলেই অমানবিক। মাঝে মাঝে আমাদেরও বেশ খারাপ লাগে। কিন্তু পুলিশকে দায়িত্বটা অনেক বড় করে দেখতে হয়। তারা ইফতারের সময় অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অনেক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইফতার করেন শুধু মাত্র রোজাদারদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। তারা নিরলসভাবে কাজ করেন। এটাই হচ্ছে আমাদের মানবিক ট্রাফিক পুলিশ।