ঝিমিয়ে পড়া বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস ডিসিপ্লিনে এ বছর নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন ইমরানুর রহমান। ক্রিকেট-ফুটবল বাদে অন্যান্য খেলার সারা বছরের পারফরম্যান্সের দিকে তাকালে সবার আগে এই লন্ডন প্রবাসী অ্যাথলেটের কথাই সামনে আসবে। এর বাইরে বড় অর্জনের চেয়ে হতাশার গল্পই বেশি। এশিয়ান গেমসের মতো বড় আসর ছিল এ বছর। সেখানে ক্রিকেটের মাধ্যমেই মান রক্ষা হয়েছে। নারী-পুরুষ উভয় বিভাগেই ব্রোঞ্জ পদক আসে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন তোফায়েল আহমেদ
ইতিহাস গড়ে ভরসার কেন্দ্রে ইমরানুর
আলোচিত এই স্পিন্টার একাধিক আন্তর্জাতিক আসরে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সবার আগে উল্লেখ করতে হবে ফেব্রুয়ারিতে কাজাখস্তানে এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের কথা। এই আসরে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক জিতে ইতিহাস গড়েন তিনি। বাংলাদেশের কোনো স্প্রিন্টারের জন্য এশিয়ান পর্যায়ে পদক জয় যেখানে স্বপ্নের ব্যাপার, সেখানে ইমরানুর স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখান। জুলাইয়ে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিয়ে সেমিফাইনালে থামেন। তবে প্রথম রাউন্ডে ১০.২৫ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে চমক দেখান। আগস্টে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপেও চমক অব্যাহত রাখেন তিনি। প্রথম রাউন্ডে হিটে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব দেখান। এগুলো আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকসে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় বড় সাফল্যই। সেপ্টেম্বরে লন্ডনের একটি ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় ১০.১১ সেকেন্ডে দৌড়ান ইমরানুর। যা এখন তার ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং।
যেভাবে পারফর্ম করছিলেন ইমরানুর, তাতে এশিয়ান গেমসেও তাকে নিয়ে বড় আশা তৈরি হয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে হাংজুতে অনুষ্ঠিত আসরে সেমিফাইনালে উঠলেও ইমরানুর পারেননি ফাইনালে উঠতে। ২০২২ সালের শুরুতে প্রথমবার জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নিয়ে ১০০ মিটারে শুধু স্বর্ণই জেতেননি ইমরানুর, ভেঙে দেন ২২ বছরের পুরোনো রেকর্ড। এরপর সামার ও জাতীয় অ্যাথলেটিকস মিলিয়ে আরও দুটি আসর বসে ওই বছর। সেখানেও শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখেন তিনি। তখন থেকেই তাকে নিয়ে আলোড়ন। আর এ বছর দেশ ছাপিয়ে বিশ্ব আসরেই রেখেছেন নিজের প্রতিভার সাক্ষর। তবে ইমরানুরে আশার আলো দেখা যাওয়ায় ফেডারেশনকে শুধু তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। অন্যরা যেন কিছুটা অবেহেলিতই থেকে গেছেন।
এশিয়ান গেমসে দুই ব্রোঞ্জেই সন্তুষ্টি
এক আসর পর এবার এশিয়ান গেমসে ক্রিকেট ফিরেছিল। সেই ক্রিকেটই মান বাঁচিয়েছে বাংলাদেশের। এই ডিসিপ্লিনের পুরুষ ও নারী- দুই ইভেন্টেই ব্রোঞ্জ জিতে বাংলাদেশ। দুই দলই হারায় পাকিস্তানকে। পুরো আসরে এই দুটি ব্রোঞ্জ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বাংলাদেশের বিশাল বহরকে। বাকি ইভেন্টগুলোতে ছিল হতাশার চিত্র। একটা সময় এশিয়ানে বাংলাদেশের ভরসার কেন্দ্রে থাকত কাবাডি। ১৯৯০ থেকে ২০১৪ আসর পর্যন্ত টানা পুরুষ বা নারী কাবাডি দলের মাধ্যমে পদক এসেছে। ২০১৮ সালে প্রথমবার কাবাডি থেকে পদক জিততে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এবারও সেই ব্যর্থতা বজায় ছিল। এশিয়ান গেমস থেকে এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত পদক একটিই। ১৯৮৬ সালের আসরে বক্সার মোশাররফ হোসেন জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ। এবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে বক্সার সেলিম হোসেন ব্যক্তিগত পদক জেতার সম্ভাবনা তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত পারেননি। অ্যাথলেটিকসে ইমরানুর রহমানের ওপর চোখ ছিল সবার। সেমিফাইনালে উঠে বড় আশাও তৈরি করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ নন তিনি। শুটিং, সাঁতার, আর্চারি, দাবা, ব্রিজ, ভারোত্তোলন, জিমন্যাস্টিক্স, ফেন্সিংয়ে কেবল হতাশাই ছিল সঙ্গী। হকি দল অষ্টমও হতে পারেনি। নারী ফুটবল দল প্রথমবার অংশ নিয়ে শক্তিশালী জাপান ও ভিয়েতনামের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে হারে। নেপালের বিপক্ষেও জয় তুলে নিতে ব্যর্থ হয়। ড্র করে ম্যাচটা। নারী দলের মতো পুরুষ দলও গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। তবে স্বাগতিক চীনের বিপক্ষে তাদের ড্র করা ছিল বড় প্রাপ্তি। ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে হারলেও বেশ লড়াই করেন ফুটবলাররা।
এএইচএফ কাপে শিরোপা, ঘরোয়া হকি স্থবির
বাংলাদেশ হকির জন্য বছরের শুরুটা ছিল দারুণ। ৬ থেকে ১২ জানুয়ারি ওমানের মাসকাটে বসেছিল জুনিয়র এএইচএফ কাপ হকি প্রতিযোগিতা। ৮ দলের এই আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ফাইনালে তারা হারায় স্বাগতিক ওমানকে। অনূর্ধ্ব-২১ বয়সীদের এই প্রতিযোগিতায় গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচেই জয়ের সুবাদে জুনিয়র এশিয়া কাপও নিশ্চিত হয়ে যায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের। তবে মে-জুনে ওমানেই অনুষ্ঠিত সেই আসরে ব্যর্থ ছিল বাংলাদেশ। ১০ দলের আসরে বাংলাদেশ বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকেই। পাকিস্তানকে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো এই আসরে শিরোপা জিতে নেয় ভারত। এ তো গেল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার চিত্র। ঘরোয়া হকির প্রসঙ্গে আসলে কেবলই হতাশার গল্প। হকি খেলোয়াড়দের ভাগ্য ফেরেনি এবারও। প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগ হকি আয়োজন করে ফেডারেশন। তবে প্রিমিয়ার লিগ আয়োজনে এবারও ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বরে সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগ শেষ হয়েছে। এরপর আর দেশের শীর্ষ হকি আসর মাঠে ফেরেনি। খেলোয়াড়দের তাই মাঠে ফেরার জন্য ব্যাকুল সময় গেছে।
আর্চারির অম্ল-মধুর বছর
ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আর্চারি এখন মানুষের প্রত্যাশার বড় জায়গা। সেই আর্চারির জন্য এ বছরকে অম্ল-মধুরই বলতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এই ডিসিপ্লিনে সাফল্য এসেছে, তবে এরই সঙ্গে বেশ কিছু আসরে হতাশও করেছেন আর্চাররা। সাফল্যের কথা বললে দিয়া সিদ্দিকী ও হাকিম আহমেদ রুবেলের নাম আসবে সবার আগে। মার্চে এশিয়া কাপ ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং টুর্নামেন্ট স্টেজ-১ এ রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে দেশকে স্বর্ণ উপহার দেন দিয়া-রুবেল জুটি। চাইনিজ তাইপেতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই প্রতিযোগিতা। জুনে সিঙ্গাপুরে ওয়ার্ল্ড আর্চারি স্টেজ-৩ প্রতিযোগিতায় দলগত ব্রোঞ্জ পদক জিতে বাংলাদেশ। ওই আসরে একের পর এক ইভেন্টে হতাশ করছিলেন আর্চাররা। শেষে মান রক্ষা করেন রিকার্ভ পুরুষ দল। দলগত ইভেন্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জয় করেন সাগর ইসলাম, হাকিম আহমেদ রুবেল ও রামকৃষ্ণ সাহা। তবে বিশ্বকাপ স্টেজ-১, স্টেজ-২ প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও সাফল্য আনতে পারেনি বাংলাদেশের আর্চাররা। এশিয়ান গেমসেও আর্চারদের ওপর বাড়তি নজর ছিল। তবে নজরকাড়া কিছু করতে পারেননি রোমান সানা, দিয়া সিদ্দিকী, রুবেলরা। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গত বছর নিষিদ্ধ হয়েছিলেন রোমান সানা। শাস্তি থেকে মুক্তির পর এশিয়ান গেমস দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ফেরেন তিনি। তবে নজরকাড়া কিছু করতে পারেননি। সতীর্থ আর্চার দিয়া সিদ্দিকীর সঙ্গে তার জীবনের জুটি বাঁধাটা ছিল এই বছর খেলাটার বড় এক খবর।
বঙ্গবন্ধু কাপ কাবাডিতে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
মার্চে ঢাকায় বসেছিল বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক কাবাডি প্রতিযোগিতার তৃতীয় আসর। এতে ১২টি দেশ অংশ নেয়। আগের দুই আসরের মতো এবারও স্বাগতিকরা শিরোপা ধরে রেখে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নের স্বাদ নেয়। ফাইনালে বাংলাদেশ তিনটি লোনাসহ ৪২-২৮ পয়েন্টে চাইনিজ তাইপেকে পরাজিত করে। প্রতিযোগিতায় কোনো ম্যাচেই হারেনি বাংলাদেশ। ফাইনালের সেরা হওয়ার সঙ্গে আসরের বেস্ট ক্যাচার নির্বাচিত হন বাংলাদেশ অধিনায়ক তুহিন তরফদার। বেস্ট রেইডারের সঙ্গে টুর্নামেন্ট সেরার স্বীকৃতি জিতেন মিজানুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কাপ কাবাডিতে ফাইনালে উঠার মধ্য দিয়ে আগামী বছর বিশ্বকাপ কাবাডিতে খেলাও নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের।
যুব গেমস ও অন্যান্য আয়োজন
এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত হয়েছিল শেখ কামাল বাংলাদেশ যুব গেমস। ২৪টি ডিসিপ্লিনে চূড়ান্ত পর্বে প্রায় ৪ হাজার প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। আরও বেশকিছু বড় আয়োজন দেখা গেছে বছরজুড়ে। দেশি-বিদেশি দৌড়বিদদের অংশগ্রহণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয় বছরের শুরুতে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিচ ভলিবল, বঙ্গবন্ধু আইএইচএফ কাপ হ্যান্ডবল, করপোরেট কাবাডি লিগের মতো প্রতিযোগার আয়োজন ছিল।