![কঠিনেরে জয় করা অন্তরা](uploads/2024/05/01/Humayra-Adhora--Tofail-1714546186.jpg)
‘আমি মনে হয় কারাতের জন্যই জন্ম নিয়েছি।’- কণ্ঠে জোরালো আত্মবিশ্বাস ও গর্ব নিয়েই কথাটা বললেন এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী কারাতেকা হোমায়রা আক্তার অন্তরা। একটু বাড়িয়েই বললেন কি? মোটেই না। প্রতিটি ক্ষণ হৃদয়ে যিনি কারাতেকে ধারণ করে চলেন, শতবাধা উপেক্ষা করে খেলাটায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন শীর্ষস্তরে, তার কণ্ঠেই তো এভাবে বলা মানায়।
হোমায়রা অন্তরার খেলাটাই এক অর্থে যুদ্ধ। ম্যাটে আক্ষরিক অর্থেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ জিততে হয় তাদের। যে যুদ্ধ জিততে জিততেই তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরাদের কাতারে। তবে তারও আগে জীবনযুদ্ধেও জয়ী হতে হয়েছে রাজবাড়ীর মেয়ে অন্তরাকে। কাটা বিছানো পথ মাড়িয়ে যেভাবে তিনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন, তা শুধুই প্রেরণা জুগানোর মতো।
অনেকের বাঁকা চাহনিকে উপেক্ষা করে কারাতে খেলতে হয়েছে অন্তরাকে। বাবা ছাড়া বড় হয়েছেন। চার বোনের মধ্যে তিনিই বড়। তাই সব সময় বাড়তি দায়িত্ববোধ কাজ করত তার ভেতর। একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতেন, ‘আমি যেভাবে যাব, আমার বোনগুলোও সেভাবেই যাবে। আমি যদি ব্যর্থ হই, আমার বোনরা দেখবে আমার লাইফটা, ব্যর্থ লাইফ। আর সফল হলে ওরাও আমাকে অনুসরণ করবে।’ কৈশর থেকেই এই বোধটা মনে জাগ্রত রেখে এগিয়েছেন অন্তরা। শুরুতে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হয়েছে। কিন্তু ডানপিঠে ও মুক্তমনা অন্তরা চাইতেন স্কুলে পড়তে। সেই চাওয়াটা তার পূরণও হয় পরে। রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে। মা তাদের চার বোনকে নিয়ে পল্টনে একটি বাসা ভাড়া নেন। মার সঙ্গেই এক দিন পাল্টনের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়ামে ঘুরতে গিয়ে কারাতের প্রেমে পড়ে যান অন্তরা। মার সম্মতিতে শুরুর হয় তার কারাতে যাত্রা।
খুব দ্রুতই কারাতে কোচদের নজর কাড়তে পেরেছিলেন অন্তরা। কিন্তু যখনই কারাতে খেলায় মন-প্রাণ সঁপে দিতে চাইছেন, তখনই দেখতে শুরু করলেন ক্রীড়াঙ্গনের অন্য রূপও। অন্তরার কথায়, ‘মেয়ে বলে কারাতে খেলাটা প্রতিবেশীরা খুব সহজভাবে নিত না। এলাকায় অনেক কথা শুনতে হতো। তবে যেখানে ট্রেনিং করতাম, সেখানেই সমস্যাটা বেশি ছিল। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে আমরা ট্রেনিং করতাম। ছেলেদের সঙ্গেই ট্রেনিং করতে হতো। অনেকেই আছেন যারা সাধারণ ক্লাব ট্রেনিং করতেন। শুধু ব্ল্যাক বেল্ট বা ব্যায়ামের জন্য কারাতে করতেন। তবে আমাদের লক্ষ্যটা ছিল একটু বড়। তাই আমরা একটু বেশি সময় অনুশীলন করতাম। কিন্তু এটা সেই সময় কেউ পছন্দ করত না। আমাদের লাইট অফ করে দিত, ফেডারেশন ও অভিভাবকদের কাছে বিচার দিত। সবাই বলত তোমরা এভাবে ট্রেনিং করো না। লাইট অফ করে দেওয়ায় আমরা অন্ধকারেও ট্রেনিং করেছি। অনেক সময় মোবাইলে আলো জ্বেলে বা দুপুর বেলা ট্রেনিং করতাম।’ অন্তরা বলে যান, ‘সবার বলা নেতিবাচক কথা তো কানে আসতই। নিজের কাছে তখন খারাপ লাগত। মাঝেমধ্যে মনে হতো, এই যে ট্রেনিং করছি এটা হয়তো ঠিক না। কেন কারাতে করতে আসলাম, এমন ভাবনাও মনে ঘুরত।’
এ তো ছিল খেলার মাঠের বাধা। মাঠের বাইরেও তো কম বাধা ডিঙাতে হয়নি অন্তরাকে। তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতেন মামা। কিন্তু সেই মামা কখনো চাইতেন না খেলাধুলা করুক অন্তরা। ‘মামা চাইতেন পড়াশোনা ভালোভাবে করি। খেলাধুলা করলে হয়তো পড়াশোনায় প্রভাব পড়বে। ভালো কিছু করতে পারব না। পিছিয়ে যাব। এ কারণে মামা অনেক রাগ করতেন। বলতেন, যদি খেলাধুলা কর তাহলে পড়াশোনা করতে হবে না। পড়াশোনা বন্ধ করে দাও।’- বলেন অন্তরা। তবু নিজেকে কারাতে থেকে সরিয়ে নেননি অন্তরা। এই খেলাটা যে তার ভালোবাসার জায়গা। কিন্তু একটা সময় তাকে পড়াশোনা ও কারাতে, দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছিল। অন্তরার মুখ থেকেই শোনা যাক গল্পটা- ‘২০১৯ সালে যখন সাফ গেমসে যাই, তখন আমি এইচএসসি শেষ করেছি। আমার বন্ধুরা তখন সবাই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিং করছে। আমিও কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর আমার সাফ গেমসের ক্যাম্পের জন্য কল আসে। ওই সময় একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়- আমি কোচিং করব, না সকাল-বিকেল ট্রেনিং করব। এসএ গেমসের সময় সবাইকে কঠোর ট্রেনিংয়ের মধ্যে থাকতে হয়। বাইরে যেতে হলেও অনুমতি নিতে হয়। কেউ আসলে ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি আমাকে পড়ালেখার জন্য কোচিংয়ের অনুমতি দিচ্ছিল না।’ অন্তরা তাই দ্বিধায় পড়ে যান, কী করবেন? কিন্তু যেকোনো একটি পথ তো তাকে বেছে নিতেই হতো। অন্তরা বলেন, ‘এতদূর চেষ্টা করার পর সাফ গেমসের মতো আসরে খেলার সুযোগ সামনে এসেছে। পরে যদি আর সুযোগ না পাই। এটা চিন্তা করে ভাবলাম পড়াশোনাটা আপাতত বন্ধ রাখি, খেলাধুলাটা করি। যদি সফল হই তাহলে তো আর আফসোস থাকবে না।’
অন্তরা বেছে নেন কারাতেকেই। তার এই সিদ্ধান্ত সঠিক প্রতিফলিত হয় এসএ গেমসে সফল হয়ে। কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ প্রথম পদকটি পায় তার হাত ধরেই। একক কাতায় দেশকে উপহার দেন ব্রোঞ্জ। এরপর কুমিতে জয় করেন স্বর্ণপদক। পরে দলগত কুমিতেও রুপা জয় করেন তিনি। আজ অন্তরা তাই গর্ব নিয়ে বলেন, ‘যদি সফল হতে না পারতাম তাহলে অনেক কষ্ট লাগত। কারণ আমার বন্ধুদের বেশির ভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। এই কষ্টটা আমার এখনো আছে। তবে সাফ গেমসের মেডেলের দিকে তাকালে এই কষ্টটা আর থাকে না।’
কষ্ট থাকবে কেন? অন্তরা তো এখন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সফল এক ক্রীড়াবিদের নাম। যাকে আইডল মানেন হাজারও মেয়ে। এসএ গেমসে অন্তরার সফলতা দেখে তার আরও দুই বোন কারাতেকে নিয়েছেন খুব সিরিয়াসভাবে। তারাও চান বোনের মতো সোনালি হাসি হাসতে। আর অন্তরার চাওয়া নিজেকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়া। যেখানে যেতে পারেননি কেউ। এশিয়ান গেমসের মঞ্চে পদক জয়ের স্বপ্নও লালন করেন তিনি।