![৩২ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় জাকসু](uploads/2024/01/20/1705734606.JU-Lead-11111.jpg)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে জাকসু নামে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৎ, মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (জাকসু) বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। একই বছর প্রথম জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভিপি নির্বাচিত হন গোলাম মোর্শেদ এবং জিএস রোকন উদ্দিন। এরপর ৭৪, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮৯, ৯০, ৯১ ও ৯২ সালে ৯ বার জাকসু নির্বাচন হয়। সর্বশেষ ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুম হাসান তালুকদার লিটন এবং জিএস শামসুল তাবরিজ।
সরেজমিনে দেখা যায়, অবহেলায় পড়ে আছে জাকসু ভবন। ভবনটির রুমগুলোর বেশির ভাগ দরজা ভাঙা পড়ে আছে। বাইরের অংশে নতুন রং করেছেন শিক্ষার্থীরা। এটি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আড্ডার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জানা যায়, এক ছাত্রের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বাধলে সে সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জাকসু ও হল সংসদ বাতিল করে। এরপর ৩২ বছর পার হলেও আলোর মুখ দেখেনি জাকসু।
১৯৭৩ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১৯ (২) ধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে জাকসু থেকে পাঁচজন নির্বাচিত প্রতিনিধির ভোটাধিকার আছে। কিন্তু জাকসু সচল না থাকায় এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেট সভায় ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বারবার শিক্ষার্থীদের জাকসু নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০১৩ সালে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জাকসু নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ২০১৯ সালের দিকে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও জাকসু নিয়ে আলাপ-আলোচনা নতুন করে শুরু হয়। সেই সময় অবিলম্বে নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরের ৩১ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে নিয়োগও দেওয়া হয়। তবে সেই নির্বাচন আর আলোর মুখ দেখেনি।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম জাতীয় নির্বাচনের পর জাকসু নির্বাচনের আয়োজনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জাকসু নির্বাচন চান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, ‘জাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি। অনেক দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জাকসু নির্বাচন হয়নি। জাকসু নির্বাচন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি পাবেন। শিক্ষার্থীদের সব দাবি ও সমস্যা প্রতিনিধিরা তুলে ধরতে পারবে। আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যেন জাকসু নির্বাচনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেন।’
ছাত্রদল জাবি শাখার সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম সৈকত বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াই হাজার শিক্ষার্থী অবৈধভাবে সিট দখল করে আছে। এরা অধিকাংশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগের অবৈধ ছাত্ররা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে হলে থেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দোকান-ক্যান্টিনে বিনা মূল্যে খাওয়া, মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে। অন্যদিকে আবাসনসংকট দেখিয়ে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। এর মধ্যে ৫৩তম ব্যাচের ভর্তি পরীক্ষাও কাছাকাছি। অথচ ভিসি বৈধ ছাত্রদলের নেতা-কর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। ক্যাম্পাসের অতিথি পাখি, জীববৈচিত্র্য নিয়েও তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে, যদি জাকসু থাকত তাহলে শিক্ষার্থীদের কথা বলার একটা প্লাটফর্ম থাকত। সবাই জবাবদিহির আওতায় আসত। প্রশাসন ও ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ও নিজস্ব দুর্নীতিসহ যাবতীয় অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে জাকসু নির্বাচন দিচ্ছে না। জাকসু নির্বাচনের জন্য প্রধান অন্তরায় হচ্ছে প্রশাসনে স্বদিচ্ছার অভাব।’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ বলেন, ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী জাকসু মনোনিত পাঁচজন সদস্য সিনেটে থাকার কথা থাকলেও প্রশাসন কোনো ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সিনেট অধিবেশন। ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া সিনেটে হওয়া বাজেট কখনোই শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারে না। জবাবদিহিমূলক ক্যাম্পাস নিশ্চিতের জন্য নির্বাচিত ছাত্র নেতৃত্ব আবশ্যক। তিন দশক হয়ে গেলেও জাকসু নির্বাচন না হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য হতাশাজনক। অন্যদিকে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচন প্রতিবছর দিব্যি চলছে। অথচ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কথা বলার জন্য বা কোনো প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষর্থীরাও জাকসু নির্বাচন চায়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফিন ইশা বলেন, ‘জাকসুর সব কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বর্তমানে তৈরি হচ্ছে না যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব। বিভিন্ন সময়ে জাকসুকে সচল করার দাবি উঠলেও আজ পর্যন্ত তার কোনো সুরাহা হয়নি। আমরা চাই যেন জাকসু নির্বাচন হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি পায়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মুজাহিদ বান্নহ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভুলতে বসেছে। গত ৩২ বছর ধরে জাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে সাধারণ ছাত্রদের দাবি দাওয়া অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি এখানে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য। আমরা চাই জাকসু নির্বাচন যেন হয় এবং শিক্ষার্থীরা তাদের যোগ্য নেতৃত্ব পান।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সামনে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচন রয়েছে। এগুলো শেষ হলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের ব্যবস্থা করব। তবে সরকারের অনুমতি না মিললে জাকসু নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব নয়।’