এক সময় ম্যালেরিয়াকে চিহ্নিত করা হতো মহামারি হিসেবে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশের পার্বত্য অঞ্চলকে মনে করা হতো ‘মৃত্যুকূপ’। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাণহানি শূন্যে নেমে আসায় সেই ধারণা বদলেছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালের পর থেকে ম্যালেরিয়ায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি রাঙামাটি জেলায়। ম্যালেরিয়া নির্মূলে সরকারি ও বেসরকারি তরফ থেকে দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসা দেওয়া আর কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণের কারণে এমন সফলতা এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ গত তিন বছরের পরিসংখ্যান বলছে, জেলায় নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে ম্যালেরিয়া। প্রাণহানি না থাকলেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এর মধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জেলায় ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৪৩৭ জন। বিশেষ করে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই সময়টায় কয়েক গুণ বেড়ে যায় আক্রান্তের সংখ্যা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত সন্ধ্যার পর কামড়ায় ম্যালেরিয়াবাহী মশা। তবে পাহাড়ি এলাকার চেয়ে সমতল এলাকার বাসিন্দারাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন ম্যালেরিয়ায়। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বিশেষত সমতলে পানি জমার সুযোগ বেশি হওয়ায় মশার উৎপাদনও হয় বেশি। এ কারণেই ম্যালেরিয়ায় বেশি আক্রান্ত হন বাঙালিরা। আবার বাইরে বিচরণ কম থাকায় পুরুষদের চেয়ে এ রোগে আক্রান্ত কম হন নারীরা। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের ভালো শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তারা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন কম। পাহাড়ের ওপর পানি জমে থাকার সুযোগ কম থাকায় মশার বংশবিস্তারও কম হয়।
রাঙামাটি জেলায় গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০০২ সালে। ওই বছর ম্যালেরিয়ায় মারা যান ১৪৩ রোগী। তবে মৃত্যুর এই সংখ্যা এর ১০ বছর পর ২০১২ সালে নেমে আসে একজনে। ২০১৩ সালে দুজন মারা যান। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত জেলায় ম্যালেরিয়ায় কারও মৃত্যু হয়নি।
রাঙামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া নির্মূলে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক যৌথভাবে কাজ করছে। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া আক্রান্তদের দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকে কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। ২০২২ সালে জেলায় ৭২ হাজার ৭৯০টি এবং ২০২৩ সালে ৫ লাখ ৬৪ হাজার ১২০টি কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ করা হয়েছে।
২০২২ সালে জেলায় জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ম্যালেরিয়া পরীক্ষা করা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬৩ জনের। ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২২০ জন। এদের মধ্যে মাইক্রোস্কপিক টেস্ট (হাসপাতালে পরীক্ষা) করিয়েছেন ৩৭ হাজার ৮৪৬ জন। ম্যালেরিয়া কিট দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন ১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ জন।
গত বছর ২০২৩ সালে ২ লাখ ১৮ হাজার ৬১১ জনের ম্যালেরিয়া পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৭১৪ জন। এদের মধ্যে মাইক্রোস্কপিক টেস্ট (হাসপাতালে পরীক্ষা) করিয়েছেন ২৫ হাজার ৫২৩ জন। ম্যালেরিয়া কিট দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮ জন।
সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৭৯০ জনের। এদের মধ্যে মাইক্রোস্কপিক টেস্ট করিয়েছেন ৪ হাজার ৪৪০ জন। ম্যালেরিয়া কিট দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন ৩২ হাজার ৩৫০ জন। ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৫০৩ জন। এদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৩০৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২৫ এবং মার্চে ৭০ জন আক্রান্ত হন।
প্রতিষ্ঠানটির রাঙামাটি জেলা কো-অর্ডিনেটর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জেলার ১০ উপজেলায় ব্র্যাকের প্রশিক্ষিত ১ হাজার ৬০০ জন স্বাস্থ্যসেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। তারা প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি পাড়ায় কাজ করছেন। রাঙামাটিতে ব্র্যাক ম্যালেরিয়া নির্মূলে দুই ভাগে কাজ করছে। কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ করা হচ্ছে আর ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত ও আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’ ‘ম্যালেরিয়া নির্মূলে মশারি একটা প্রধান উপাদান। এখনকার ম্যালেরিয়া চিকিৎসার ওষুধে সহনশীল মাত্রা থাকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। আক্রান্তের এক সপ্তাহের মধ্যে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছেন’- যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
রাঙামাটির ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. এন্ড্রু বিশ্বাস বলেন, ‘সবচেয়ে ম্যালেরিয়াপ্রবণ জেলা রাঙামাটিতে ২০১৬ সালের পর থেকে ম্যালেরিয়ায় কোনো মৃত্যু নেই। সিভিয়ার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হারও খুবই কম। এ বছর কোনো সিভিআর ম্যালেরিয়ার কেস আমাদের নেই। তবে ২০২১ থেকে ২০২৩ এই তিন বছর জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
জেলায় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির অধীনে ম্যালেরিয়া রোগীদের দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসসেবা দেওয়া এবং কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। আমরা এর সুফলও পাচ্ছি।’