দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে যখন দিনমজুর স্বামীর রোজগারে সাধ আর সাধ্যের টানাপড়েনে হাঁসফাঁস অবস্থা গৃহবধূ শাবানা বেগমের, তখন এক মাসের বিদ্যুতের বিল যেন তার কাছে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। দোচালা টিনের ঘরে দুটি ফ্যান, তিনটি বাল্ব আর একটি ফ্রিজ চালানোর খেসারত গুনতে হচ্ছে ৬৩ হাজার ৩৬৫ টাকা। তাই কপালে পড়েছে তার দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
শুধু শাবানা বেগমই নন, আকস্মিক এমন ভূতুড়ে বিলে দিশেহারা রাঙামাটির পৌর এলাকার পুরানপাড়া, ইসলামপুর ও শরীয়তপুরের অর্ধশত গ্রাহক। তাদের মার্চ মাসের এক বিলেই কারো কারে দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার থেকে ৭৮ হাজার টাকা পর্যন্ত; যা পরিশোধের শেষ সময় ছিল গত ২৮ এপ্রিল। গ্রাকদের দাবি, আগে মাসে এক হাজার টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল এলেও নিয়মিত পরিশোধের পরও প্রিপেইড মিটার পরিবর্তনের নামে এমন ভূতুড়ে বিল চাপিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ অফিস। তবে বিদ্যুৎ অফিস বলছে- রাজস্ব মওকুফের কোনো সুযোগ নেই। তবে গ্রাহকরা চাইলে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
এসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষই দিনমজুর ও জেলে। তাই একদিকে বকেয়া পরিশোধের অসামর্থ্যতা অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংযোগ কাটা পড়ার দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে তাদের। সম্প্রতি পুরনো ডিজিটাল মিটার পরিবর্তন করে নতুন প্রিপেইড মিটার সংযোগ পাওয়ার পর এমন ভোগান্তিতে পড়েন এই গ্রাহকরা। ভোগান্তি নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।
সম্প্রতি সরকার ঘোষিত ডিজিটাল মিটার পরিবর্তন কর্মসূচির অধীনে রাঙামাটি জেলায় এরই মধ্যে ৩ হাজার ৬০০ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাদের মধ্যে এমন ভূতুড়ে বিলে বিপাকে পড়েছেন অর্ধশত গ্রাহক। এ নিয়ে গত ২৮ এপ্রিল বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েও গ্রাহকরা সমাধান পাননি।
এমন ভোগান্তি নিয়ে কথা হয় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে। পুরানপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল আজিজের স্ত্রী শাবানা বেগম। ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরে বিদ্যুতে চলে দুটি ফ্যান, তিনটি বাল্ব আর একটি পুরনো ফ্রিজ। ভাই মো. হারুনের নামেই স্থাপন করা আছে মিটার সংযোগটি। শাবানা বেগম বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে বিল এসেছিল, ১ হাজার ১১১ টাকা, জানুয়ারিতে ৯১৯ টাকা। মিটার পরিবর্তনের পরে ভেবেছিলাম শেষ বিলে আসবে বড়জোড় আর ৫০০ টাকা। কিন্তু কার্ড মিটার দেওয়ার পরে আসছে ৬৪ হাজার ৩৩৫ টাকা! এই গায়েবি বিল কোত্থেকে এল। আমার আগের তো সব বিল পরিশোধ করা আছে। সংসার চালাতে পারি না। বিল কীভাবে দেব? আমি এর বিচার চাই।’
ওই এলাকার মো. রফিক বলেন, ‘মিটার বদলানোর পরে বিল দিয়েছে ৩ হাজার ৪২ টাকা। পরিশোধ করেছি। এরপরে বিল দিয়েছে ৭৭ হাজার ৩১৩ টাকা। এত বিল কীভাবে এল আমার বুঝে আসছে না। গত ২৮ এপ্রিল বিদ্যুৎ অফিসে আমরা সবাই গিয়েছি। তারা প্রত্যেককে আলাদাভাবে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছে। তারা ঢাকায় পাঠাবে, মন্ত্রণালয় থেকে কিছু করা যায় কি না চেষ্টা করবে। কিন্তু এখনো কোনো সুরাহা পাইনি।’
স্থানীয় খোরশেদ আলম বলেন, ‘প্রতিমাসে এক হাজার টাকার নিচে বিল আসত। মিটার পরিবর্তনের পরে এসেছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। জিগ্যেস করেছি আর কোনো বিল আসবে কি না? তারা বলেছিল আর ছয় দিনের বিল আসবে। ভেবেছি খুব বেশি হলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আসবে। কিন্তু দিয়েছে ৫২ হাজার টাকার বিল! কাপ্তাই হ্রদে বাবার সঙ্গে মাছ ধরে সংসার চালাই। এত টাকা কীভাবে দেব? আবার বকেয়ার জন্যও লাইন কেটে দেবে। কী করার আছে বুঝতে পারছি না।’
মো. রফিক বলেন, ‘আগে ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা বিল আসত। সারা বছর বিল পরিশোধ করেছি। মিটার পাল্টানোর পরে ১১৭৭ টাকা বিল দিয়েছে। এরপর আবার ২৩ হাজার ৮০৫ টাকার বিল দিয়েছে!’ আব্দুল গফুর বলেন, ‘ডিজিটাল মিটারে আসত ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। কিন্তু প্রিপেইড মিটার দিয়ে বিল দিয়েছে ১০ হাজার ৩০৪ টাকা। মিটার খুলে নেওয়ার সময় আমাদের রিডিংও দেখায়নি, কিছু বলেওনি। এখন এই বিল দিয়ে হয়রানি করছে।’
গ্রাহকদের এই ভোগান্তির সুরাহা ও দায় নিয়ে কথা বলেছেন রাঙামাটি বিউবোর বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দীন। তিনি বলেন, লোকবল সংকটে নিয়মিত মিটার রিডিং নিতে না পাড়ায় পুরনো মিটারে এই পরিমাণ বিল জমেছে। গ্রাহকদের মিটার পরিবর্তনের সময় যে পরিমাণ রিডিং ছিল তা নেওয়া হয়নি আগে। রাজস্ব মওকুফের কোনো সুযোগ নেই। তবে গ্রাহকরা চাইলে পরবর্তী কয়েক মাসের কিস্তিতে বিল পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।’