![পুলিশ পাহারায় হাটে মায়ানমারের অবৈধ গরু-মহিষ](uploads/2024/06/04/Mayanmer-cattle-1717486078.jpg)
মায়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত চলমান। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্তে কড়া পাহারায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ঈদুল আজহা সামনে রেখে কড়াকড়ির মধ্যেও কক্সবাজার ও বান্দরবানের কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অবাধে আসছে মায়ানমারের গরু-মহিষ। চোরাইপথে আসা এসব গরু-মহিষ হাটে তুলতে সহায়তা করছেন পুলিশের একাধিক সদস্য। যার ফলে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন দেশের খামারিরা।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, রামু, চকরিয়া, আলীকদম, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি, ফুলতলী, লম্বাশিয়া, ভাল্লুক খাইয়া, চাকঢালা, দৌছড়িসহ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে মায়ানমার থেকে অবৈধভাবে শত শত গরু-মহিষ আসছে বাংলাদেশে। সীমান্তের এপার-ওপারের সবাইকে ম্যানেজ করে গরু-মহিষ বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। এ কাজে একাধিক সিন্ডিকেটের সদস্যরা রাত-দিন কাজ করছেন। চোরাইপথে এভাবে পশু পাচার করতে গিয়ে কেউ কেউ সীমান্তরক্ষীদের গুলির মুখে পড়ছেন, আবার কেউ কেউ দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হচ্ছেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ফুলতলী, লম্বাশিয়া, ভাল্লুক খাইয়া, চাকঢালা ও দৌছড়ির পয়েন্টে চোরাইপথ দিয়ে প্রতিদিন অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে গরু-মহিষ এবং বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এসব অবৈধ পণ্যের চালান নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন চোরাকারবারি চক্র। সন্ধ্যা নামলেই ফুলতলীর পথ দিয়ে চোরাই গরু আনার কাজ শুরু হয়। এরপর এশার নামাজের পর রাস্তাঘাটে লোকজন কমে গেলে গরুর পাল প্রশাসন ও বিজিবি টহল দলের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে কারবারিরা। মায়ানমার থেকে আনা চোরাই গরু পাহাড়ে ও খামারে মজুত করে চোরাকারবারিরা। পরে বাজার ইজারাদারের কাছ থেকে রসিদ সংগ্রহ করে খামারির গরু পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে থাকে। এতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অন্যদিকে চোরাইপথে গরু-মহিষ আসায় সংকটের মুখে পড়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ির পাঁচটি ইউনিয়ন ও কক্সবাজারের রামু, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ও ঈদগড়ের খামারিরা। বিভিন্ন সময় বিজিবির সদস্যরা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চোরাইপথে আনা শত শত গরু-মহিষ আটক করে থাকেন। সেগুলো প্রশাসন ও বিজিবির উদ্যোগে নিলামে বিক্রি করা হয়।
যেভাবে পুলিশের সহায়তায় হাটে ওঠে গরু-মহিষ
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা এসব গরু-মহিষ হাটে তোলার পর বৈধ হিসেবেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। যার বড় সহযোগী রামুর গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। তাদের রয়েছে ১১ জনের একটি সিন্ডিকেট। যার নেতৃত্ব দেন বেলাল মিস্ত্রির ছেলে মোহাম্মদ সোহেল। গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন সোহেল ও অনিক। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মায়ানমার থেকে আসা গরুপ্রতি ২ হাজার টাকা করে নেন সোহেল, যা নেওয়ার সময় সাইফুলের দেওয়া বিশেষ চিহ্নের টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ টোকেন না থাকলে হাটে যেতে দেয় না পুলিশ। যদি টোকেন থাকে, তাহলে সেই গরু পাহারায় প্রবেশ করে গর্জনিয়ার গরুর বাজারে। এসব পরিচালনা করেন ওই ফাঁড়ির কনস্টেবল আজমীর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গরুর বেপারি খবরের কাগজকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা আসেন গর্জনিয়া বাজারে। কারণ মায়ানমার থেকে আসা গরু-মহিষ অনেক কম দামে পাওয়া যায়। নিতেও সুবিধা। পুলিশকে ২ হাজার টাকা দিলে বাজার তুলে শুধু রিসিপ্টটা নেওয়া হয়। এখানে পুলিশ, সোর্স ও ইজারাদারের কয়েকজন মিলে সিন্ডিকেট করেছে। তাদের কথার বাইরে গেলে কেউ আর গরু নিয়ে ফিরতে পারবেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত সোহেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘টাকা আমি আগে তুলতাম। এখন না। এখন অন্য কেউ তুলতেছে।’ টাকা নেওয়ার ডকুমেন্ট রয়েছে প্রতিবেদকের কাছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এ ব্যাপারে জানতে কনস্টেবল আজমীরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফাঁড়ির পরিদর্শক সাইফুল ইসলামের সরকারি ও ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু তাহের দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ছুটিতে থাকায় কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ওসি (তদন্ত) ইমন চৌধুরী এ বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, যদি পুলিশের নামে কেউ টাকা তুলেছে এমন প্রমাণ মেলে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই কাজে যদি পুলিশের কেউ জড়িত থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুশ্চিন্তায় দেশীয় খামারিরা
ঈদুল আজহা সামনে রেখে নানা কৌশলে মায়ানমার থেকে চোরাইপথে দেশে গরু-মহিষ আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি বলেছে, দেশের বেশ কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর বেশি পরিমাণে প্রাণী ঢুকছে। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এটি হচ্ছে, আবার কখনো প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে। তাতেই হুমকিতে পড়েছেন খামারিরা। সারা বছর ধরে তাদের অপেক্ষা কোরবানির ঈদের জন্য। উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে মায়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা গবাদিপশু।
রামুর খামারি খলিলুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, রামুর গর্জনিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও চকরিয়ার হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে মায়ানমার থেকে অবৈধ পথে আসা এসব পশু। এভাবে গরু আসায় বড় লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি। এসব বিদেশি পশুর সঙ্গে নানা ধরনের রোগবালাইও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন খলিলুর। সীমান্তপথে গরু আসা বন্ধে কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
খামারি অ্যাডভোকেট শামীম হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের একমাত্র সীমান্তহাট ঘুরেছেন। এ সময় হাটে তোলা বেশির ভাগ পশুই বিদেশি গরু বিক্রি হতে দেখেছেন তিনি। তিনি বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের যোগসাজশে চোরাই গরু আনা হচ্ছে। বর্তমানে সীমান্ত এলাকার হাটগুলো চোরাই গরুতে ভরে গেছে। এ অবস্থায় কোরবানি মৌসুমের ব্যবসা নিয়ে আতঙ্কে আছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চোরাইপথে গরু আনতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণ
অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর মদদে দুই দেশে গরু-মহিষ ছাড়াও মাদকদ্রব্য পাচার করছে চোরা কারবারিরা। গরু চোরাকারবারে মুনাফা বেশি হওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনও এখন ছুটছেন সীমান্তের চোরাইপথে। মায়ানমার সীমান্তের ওপারে কর্তব্যরত সদস্যদের মাথাপিছু ৫০০ টাকা দিয়ে গরু-মহিষ বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে। সীমান্তের এপারেও সবাইকে ম্যানেজ করে গরু-মহিষ বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। সীমান্ত গলিয়ে চোরাইপথে মহিষ পাচার করতে গিয়ে সর্বশেষ গতকাল সোমবার ভোরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বিজিবির মাদক ও চোরাচালানবিরোধী টহল দলের ওপর ডাকাত দলের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়।
সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ৪৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের জারুলিয়াছড়ি সীমান্তে শূন্যরেখা থেকে কিছু ভেতরে মায়ানমারের ভূখণ্ডে স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিন বাংলাদেশি আহত হন। তারা হলেন রশিদ উল্লাহ, মোহাম্মদ মফিজ উল্লাহ ও মো. আব্দুল্লাহ। তাদের সবার বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভীকাটা গ্রামে। এদের মধ্যে মাইন বিস্ফোরণে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। অন্য দুজনের হাত, বুক ও মুখ ঝলসে গেছে।
এর আগেও একই এলাকায় মাইন বিস্ফোরণে আহত হন আরও দুই বাংলাদেশি। তারাও অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে সীমান্তের ওপার থেকে গরু আনতে গিয়েছিলেন। মায়ানমারে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও সে দেশের সেনাবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে তারা আহত হয়েছেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তের ওপারে মায়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সে দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধ চলার কারণে দুই পক্ষই সীমান্ত এলাকায় ‘অ্যান্টিপারসোনাল মাইন’ বা স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে। এ পর্যন্ত ৩২টি মাইন পুঁতে রাখার তথ্য মিলেছে। সীমান্তে চোরাচালানে জড়িত থাকা লোকজন এসব এলাকা ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায়ই বিস্ফোরণের কবলে পড়ে হতাহত হচ্ছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।