‘মা আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ভিটাটুকু বিক্রি করে হলেও আমাকে তাড়াতাড়ি বের করো। ওদের মারধর আর সহ্য করতে পারছি না। পুরো শরীরে ঘা হয়ে গেছে। টাকা পাঠিয়ে আমাকে জান ভিক্ষা দাও মা...।’ লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হওয়া ওয়াসিম আলী (৩২) ফোন করে এভাবেই মায়ের কাছে বেঁচে ফেরার আর্তনাদ জানান। হতদরিদ্র মা তার সন্তানকে বাঁচাতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। গত ছয় মাস ধরে সন্তানের জন্য কেঁদে কেঁদে তিনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। পুলিশের কাছে গিয়েও আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের সায়বাড় গ্রামের আব্দুর সাত্তার ও পেমেলা বিবির সন্তান ওয়াসিম আলী। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে প্রায় এক বছর আগে একই গ্রামের মিলন নামে এক তরুণের মাধ্যমে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে লিবিয়া যান। সেখানে একটি হাসপাতালে চাকরি পান। ভালোই চলছিল। লিবিয়ায় আগে থেকে কাজ করতেন ওয়াসিম আলীর চাচাতো ভাই ইসমাইল হোসেন। তিনি ওয়াসিমকে ইতালি যাওয়ার প্রস্তাব দেন। দেখান আর ভালো থাকার স্বপ্ন। সেই ফাঁদেই পা দেন ওয়াসিম। ছয় মাস আগে ইতালি পাঠানোর জন্য ইসমাইল তাকে একটি গাড়িতে তুলে দেন। তারপর টানা ১৫ দিন তার কোনো খোঁজ মেলেনি।
একদিন কল আসে মা পেমেলা বিবির নম্বরে। কথা হয় ওয়াসিমের সঙ্গে। কিন্তু সেই কলটি মায়ের চোখের পানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ছেলে এখন ‘মানব পাচারকারীদের’ হাতে জিম্মি! তাকে বাঁচাতে হলে ১৪ লাখ টাকা দিতে হবে। মায়ের আর্থিক দৈন্যের কথা জেনে ওয়াসিম ভিটা-বাড়ি বিক্রি করে হলেও টাকা দিতে বলেন। সেই থেকে পেমেলা বিবির জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ অন্ধকার। জনপ্রতিনিধি আর থানার বারান্দা ঘুরে শেষ পর্যন্ত গত বুধবার তিনি আদালতের লিগ্যাল শাখায় অভিযুক্ত ইসমাইল ও তার পরিবারের নামে নালিশ জানান। কিন্তু ওই বৈঠকে ইসমাইলের পরিবারের কেউ আসেননি। গতকাল তিনি ছেলের মুক্তি চেয়ে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন।
এর আগে পেমেলা বিবি খবরের কাগজের প্রতিবেদকে বলেন, ‘ওয়াসিমকে ইতালিতে যেতে ইসমাইল প্রলুব্ধ করে। এমনকি সে নিজে গাড়ি পাঠিয়ে ওয়াসিমকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ১৫ দিন পর জানতে পারি ওয়াসিম মাফিয়াদের হাতে জিম্মি। তাকে ছাড়াতে টাকা দিতে হবে। আট লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো ছেলের মুক্তি মেলেনি।’
ওয়াসিম আলীর মা আরও বলেন, ‘ছেলের মুক্তিপণ হিসেবে তারা কখনো ১৪ লাখ, আবার কখনো ১৫ লাখ টাকা দাবি করে। তাদের জানিয়েছি, আমি গরিব মানুষ, টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাও তারা শোনেনি। ছেলেকে মারধর করে। ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় হোটেলের কাজ ছেড়ে রাজশাহীর বাড়িতে চলে আসি। তারা বলে টাকা পাঠান, না হলে আপনার ছেলেকে আর জীবিত পাবেন না। জমি বিক্রি আর সুদের ওপর টাকা নিয়ে তাদের পাঠিয়েছি। ছেলের মুক্তির আশায় ইসমাইলের বাবা-মায়ের হাত-পা ধরেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
ওয়াসিমের মামা আব্দুল জলিল বলেন, ‘ওয়াসিম আর ইসমাইল সম্পর্কে চাচাতো ভাই। মূলত তার ভরসাতেই ওয়াসিম লিবিয়ায় যায়। সেখানে একটা হাসপাতালে কাজ পায়। তখন ইসমাইল বারবার ওয়াসিমকে ইতালি পাঠাতে চায়।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত ইসমাইলের বিরুদ্ধে এর আগেও লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। তার মাধ্যমে এলাকার ও আশেপাশের যারা লিবিয়ায় গিয়েছেন তারা বিভিন্ন ভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ ইসমাইলের পরিবারকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার বিনিময়ে লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকে দেশে ফিরেছেন সায়বাড় গ্রামের রহেদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল। তিনি গত পাঁচ মাস আগে দেশে ফিরেছেন।
দুর্গাপুরের ঝালুকা ইউনিয়নের সায়বাড় আট নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল আওয়াল মোল্লা বলেন, ‘ওয়াসিমের পরিবার যেদিন ইসমাইলের পরিবারকে তিন লাখ টাকা দিয়েছিল, সেদিন আমি ছিলাম। পরে আবার টাকা চেয়েছিল। তাদের দাবি ১২ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে টাকা দিয়েছে কি না, জানা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসিমের বাবা-মা বলছেন, ইসমাইল বিদেশে মানুষ নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে টাকা নেন। এর আগেও নাকি তিনি এমনটি করেছেন। একই এলাকার মিলন ও ইসমাইলকে ৫২ দিন ধরে এইভাবে আটকে রেখে মুক্তিপণ নিয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক। তারা রাজশাহী লিগ্যাল অফিসে অভিযোগ দিয়েছে। আমরাও নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করছি।’
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসিমের মামা আব্দুল জলিল বলেন, ‘ইসমাইলের ভাষ্য অনুযায়ী মাফিয়ারা আমার ভাগ্নেকে অপহরণ করেছে। কিন্তু আমরা মনে করছি, এই ঘটনায় ইসমাইল নিজেই জড়িত।
আমরা অনেক কষ্ট করে দুবারে আট লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু এরপরও তাকে ছাড়েনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুর্গাপুর থানায় কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু থানায় গেলে পুলিশ বলে বাইরের দেশে অপহরণ হয়েছে, আমরা কী করব। তারা অভিযোগ নেন না। আমরা ফিরে আসি।’ যদিও দুর্গাপুর থানার ওসি খাইরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এমন বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। তাই বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’