বাজারে ডালের দাম বেড়েই চলেছে। মুগ, মসুর, ছোলা, ডাবরি, খেসারি, অ্যাঙ্কারসহ সব ধরনের ডালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে দেশের বাজারে ডালের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বাজার বিশেষজ্ঞরা ডলার সংকটের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকেও দায়ী করেছেন।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেছেন, ডালের বাজার আমদানিনির্ভর। ডলার সংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছে না। আর এতে বাজারে চাহিদার তুলনায় ডালের সরবরাহ কমেছে। সরবরাহে ঘাটতির কারণে দাম বেড়েছে।
ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকেও ডালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দায়ী করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে বাজারে ডালের দাম যতটা বাড়ার কথা কিছু সুযোগ সন্ধানি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে দাম তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এতে সাধারণ ক্রেতার ভোগান্তিও বেড়েছে। ডাল আমদানি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি করতে হবে।
সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে ডালের দাম বেশি বেড়েছে এমন অভিযোগ স্বীকার করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সাধারণ আয়ের অনেক ক্রেতাই প্রশ্ন তুলেছেন, দাম বাড়ার কারণে, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফলসহ অনেক খাবার খাওয়া কমিয়েছি। এখন ডালের দামও বেড়েছে। আমরা কী খেয়ে বাঁচব?
মিরপুর ৬ নম্বর বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্য কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী সালেহ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, দুই বছর থেকে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনিসহ সব ধরনের খাবারের দাম বেড়েছে। মাছ, মাংস, মুরগি, ডিম, দুধ কোনটা দাম বাড়েনি বলেন! কিন্তু বেতন এক টাকাও বাড়েনি। দাম বাড়ার কারণে কত কিছু যে খাওয়া বাদ দিয়েছি। ডাল, ভর্তা, ভাজি চলে সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন। কিন্তু যেভাবে ডালের দাম বেড়েছে তাতে ডাল খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
মহাখালী কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা পোশাকশ্রমিক রেবেকা সুলতানা খবরের কাগজকে বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ভাতের সঙ্গে ডাল খেয়েই দিন পার করি। কিন্তু হঠাৎ করেই ডালের দাম এমন বেড়েছে এখন কেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তবে খাব কী? গতকাল ও আগের দিন রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর বাজার, কারওয়ানবাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে এবং সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য নিয়ে দেখা যায়, সব ধরনের ডালের দাম বেড়েছেই চলেছে।
প্রতি কেজি মসুর ডাল (বড় দানা) ১১০ টাকা, মসুর ডাল (মাঝারি দানা) ১২৫ টাকা, মসুর ডাল (ছোট দানা) ১৪০ টাকা, মুগ ডাল (মানভেদে) ১৬৮ টাকা থেকে ১৭০ টাকা এবং অ্যাঙ্কর ডাল ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ছোলার ডাল (মানভেদে) ৯৫-৯৬ টাকা, খেসারির ডাল ১০০ টাকা, ডাবলি ৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। টিসিবির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এক মাসের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, অ্যাঙ্কর ডালের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ থেকে ৭ শতাংশ ও ছোলা ডালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এক মাসে মুগ ডালের দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। গত এক মাসে মানভেদে ছোলার ডালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশের মতো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ডাল চাষ করা হয়। এসব জমিতে ডাল উৎপাদন হয় প্রতি বছর গড়ে ৯ লাখ ৫০ হাজার টন থেকে ১০ লাখ টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মাথা পিছু ৪৫ গ্রাম থেকে ৫০ গ্রাম করে দেশের ডালের চাহিদা রয়েছে ২৮ লাখ টনের মতো। চাহিদানুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় দেশে বছরে গড়ে ১৫-১৭ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের ডাল আমদানি করতে হয়।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নেপাল থেকে দেশে বিভিন্ন ধরনের ডাল আমদানি হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত থেকেও ডাল আমদানি শুরু হয়েছে। সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয় অ্যাঙ্কর ডাল। স্বল্প আয়ের মানুষ সাধারণত এই ডাল কিনে থাকে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় এই ডাল বেশি বিক্রি করা হয়। পেঁয়াজু, বেগুনির উপকরণ বেসন তৈরিতেও এই ডাল ব্যবহৃত হয়। এ ডালের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত বাজারে প্রতি কেজি অ্যাঙ্কর ডালের দাম ছিল ৫০ টাকার নিচে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। এর আগের অ্যাঙ্কর ডালের দাম এত বেশি কখনো হয়নি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) অ্যাঙ্কর ডাল আমদানি হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার টন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-ডিসেম্বর) অ্যাঙ্কর ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার টন। ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় গত মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬১ হাজার টন অ্যাঙ্ককর ডাল কম আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ, সামনে রমজান। ডালের চাহিদা আরও বাড়বে। এলসি খোলার সুযোগ না পেলে এ ডালের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ আরও বিপাকে পড়বে বলে মনে করছি।