প্রচণ্ড খরতাপে যখন গায়ে জ্বালা ধরে, তখন ইচ্ছে করে জাদুমন্ত্রে বৃষ্টি নামিয়ে দিই, না পারলে কোনো গাছের ছায়ায় ছুটে যাই। দাহদিনে শান্তির এক পরম জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম কমলগঞ্জে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে। বনের পথে গাছের ঘন ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, এ যেন অন্য দেশ, অন্য কোথাও। এমন হিমেল পরশ পাব কোথায়?
উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের পাশে নানা রকমের গাছগাছড়া দেখতে দেখতে একসময় হাজির হলাম লাউয়াছড়া ফরেস্ট অফিসের রেস্ট হাউসে। তার সামনে এক বিশাল চালমুগরাগাছ। অনেক উঁচুতে কচি ফল ধরে আছে। জানা গেল, গাছটা সিলেটের অরণ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায়। আছে কক্সবাজারেও। গাছটি অনেক ভেষজ গুণে গুণান্বিত। কী সে গুণ, তা আর জানা হলো না। ছবিও তোলা হলো না। ফিরে এলাম ঢাকায়। তবে ফিরে আসার আগে জেনে এলাম, সিলেটের লোকেরা এ গাছকে বলে ডালমুগরা।
পয়লা শ্রাবণে ছুটে গেলাম মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের এ রকম জনমানবহীন দৃশ্য এর আগে আর কখনো চোখে পড়েনি। একটা সেকশনের মধ্যে নামফলকে চালমুগরা গাছের নামটা দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু খুঁজতেই পেয়ে যাই গাছটা। মাঝারি আকারের বৃক্ষ, প্রায় দশ-বারো মিটার লম্বা, কাণ্ড সোজা—সরল ও গোলাকার। গাছে দোলানো ঝোলানো ডালপালা। ডালের দুই পাশে সাজানো চকচকে সবুজ লম্বা লম্বা আয়তাকার পাতা, পাতার কিনারা সমান, তবে সামান্য ঢেউখেলানো, অগ্রপ্রান্ত সুচালো, শাখার দুই পাশে পাতাগুলো বিপরীতভাবে সজ্জিত, একেবারে আগায় বা শীর্ষে একটি পাতা, শিরা স্পষ্ট দেখা যায়। শাখায় শাখায় দুলছে গোল গোল বলের মতো নস্যি রঙের ফল। কোনো ডালে কোনো ফুল নেই, ফুল ফোটা শেষ হয়ে গেছে আরও আগেই। গ্রীষ্ম-বর্ষা ফুল ফোটার সময়। ফুলের রং হালকা হলুদ, কখনো একক আবার কখনো কয়েকটা ফুল থোকায় ফোটে, ফুলে ঘ্রাণ আছে।
ফল পাকবে আরও পরে, সাধারণত হেমন্তের দিকে পরিপক্ব হয়। ফল সুগোল, শক্ত কাঠের মতো পুরু খোসা, বাদামি। ভেতরে ভুট্টার দানার মতো কয়েকটা বীজ থাকে। পরিপক্ব হলে সেসব ফল সংগ্রহ করে বীজ বের করা হয়। বীজ পিষে তেল বের করা হয়। চালমুগরা তেল অত্যন্ত ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ গাছের আর কোনো অংশকে ঔষধার্থে ব্যবহারের পরামর্শ প্রাচীন বৈদ্যরা দেননি। চক্রপাণি দত্ত তার প্রণীত ‘চক্রদত্ত সংগ্রহ’ গ্রন্থে অর্শরোগে চালমুগরার তেল পান করার উপদেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এও বলা হয়েছে যে, যেভাবে তিল থেকে তেল বের করা হয়, সেভাবে চালমুগরার বীজও পিষে নিলে তেল পাওয়া যায়। চালমুগরার তেল বিভিন্ন চর্মরোগ, বাত ও দেহের কোনো স্থানে থেঁতলে গেলে সেখানে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।
তেল মালিশ করলে চুলকানি থাকলে তাও সেরে যায়। এমনকি মাথার খুশকি দূর করতে চালমুগরার তেল মাথায় মাখা হয়। অতীতে কুষ্ঠরোগ হলে রোগীকে একঘরে করে রাখা হতো। তাকে ঘৃণার চোখে দেখত সমাজ। এমনকি কুষ্ঠরোগীকে সে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতো। কিন্তু সে যাবে কোথায়? শেষে গ্রামীণ বৈদ্যরাই তাকে চালমুগরার তেল ব্যবহারের নিদান দিতেন। বলতেন, কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক অবস্থায় চালমুগরার তেল গরম করে তাতে সামান্য মৌ-মোম মিশিয়ে মলমের মতো করে লাগালে ও চালমুগরার তেল ১০ ফোঁটা মাত্রায় দুই বেলা খেলে কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এ উপদেশ দিয়েছেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তার ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে।
চালমুগরার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Hydnocarpus kurzii ও গোত্র Flacourtiaceae। এ গাছ চিরসবুজ প্রকৃতির, অর্থাৎ শীতে এর পাতা ঝরে না। কাঠ খুব শক্ত, কাঠের ভেতরের রং সাদা, বাইরের রং হলদে, বাকল ধূসর। গাছের আদি নিবাস ভারতবর্ষ ও মায়ানমার। সে অর্থে গাছটি আমাদের দেশি। তবে চালমুগরাগাছ সমতলের চেয়ে ত্রিপুরা, খাসিয়া পাহাড় বা সিলেট অঞ্চল, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, কক্সবাজারের অরণ্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, ইয়াঙ্গুন প্রভৃতি এলাকায় ভালো জন্মে।
চালমুগরাগাছ এত ঔষধি গুণের হলেও তার ব্যবহার সেভাবে এখন আর হয় না। অকম্মা গাছের খাতায় চলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বন থেকেও সে হারিয়ে যাচ্ছে। এ গাছকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এর প্রকৃত আবাসস্থলে চারা লাগাতে হবে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সমতলে না লাগিয়ে পাহাড়ের মধ্যদেশ থেকে পাদদেশ পর্যন্ত চালমুগরাগাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে।