ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রক্তক্ষরা ব্লিডিং হার্ট ফুল

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১০:৩৯ এএম
আপডেট: ১৭ মে ২০২৪, ১০:৪০ এএম
রক্তক্ষরা ব্লিডিং হার্ট ফুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলের সামনে ফোটা ব্লিডিং হার্ট ফুল। ছবি: লেখক

বৈশাখের এক নম্র সকাল। রোদের তাত তখনো বাড়েনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের পথে হাঁটছি। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি কোথায় কোন গাছে আজ কী ফুল ফুটল। হঠাৎ পেয়ে গেলাম জাপানি হানিসাকল আর ব্লিডিং হার্ট গাছ। দুটোই লতানো। ভূশায়িত হয়ে কিছুটা মাথা তুলে গাছ দুটো আকাশ দেখার চেষ্টা করছে। 

আশপাশের বিশাল মেহগনি আর নাগলিঙ্গম গাছের ছায়ায় ওরা আচ্ছন্ন। সকাল বলে তবু তেরছা হয়ে একমুঠো রোদ্দুর এসে পড়েছে গাছগুলোর গায়ে। ছোট গাছের বড় গাছদের কাছ থেকে যেন এ গাছের চলছে করুণা ভিক্ষা- দাও আলো, দাও জীবন হে আমার বয়োজ্যেষ্ঠ। গাছগুলোকে দেখে বড় করুণা হলো। বেঁচে থাকার এক দুর্মর বাসনা নিয়ে ওরা টিকে আছে আসলে সেখানকার মালীদের যত্নে। এই যত্নটুকুর জন্যই হয়তো ওরা উজাড় করে ফুল ফোটাচ্ছে, আনন্দ দিচ্ছে মানুষকে।   

এত সব প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সে গাছকে দেখে মনে হয়, ওদের যেন কোনো বেদনা নেই, কষ্ট নেই। কোনো পুষ্পপ্রেমিক হয়তো তাকে কোনো দিন দেয়নি কোনো ব্যথার ছোঁয়া। বরং তার লতানো শরীরে ঝুলে থাকা দুলের মতো গোছা গোছা ফুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি আদরের হাত। তবু সে যেন এক দুঃখী রাজকন্যা, তার বুক চিরে ঝরে রক্তের ফোঁটার মতো খুদে খুদে পাঁচ পাপড়ির রক্তলাল ফুল। এ জন্যই বোধ হয় ওর ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে ব্লিডিং হার্ট। বাংলা কিরণময়ী নামটা ভারতীয়, তবে নামটা কিরণময়ী না হয়ে করুণাময়ী হলে মনে বেশি মানাত। 

বাংলাদেশে এর বাংলা নামকরণ করা হয়েছে হৃদয়হারা বা হৃদয়ক্ষরা। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Clerodendrum thomsoniae, গোত্র ভার্বেনেসী। অর্থাৎ এ গাছ ভাঁটফুলের সহোদর। এ ফুলের এরূপ উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামকরণের অনুরোধ করেন নাইজেরিয়ার এক মিশনারি চিকিৎসক রেভারেন্ড উইলিয়াম থমসন, তার প্রয়াত স্ত্রীর নামের সম্মানে, তাই এর নামাংশ দেওয়া হয় থমসনি, ক্লিরোডেনড্রাম গ্রিক শব্দের, যার অর্থ চান্স ট্রি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ ফুলের সৌন্দর্যের কারণে ইংরেজি নাম ছিল বিউটি বুশ। 

এটি আমাদের দেশের গাছ না, গাছের উৎপত্তিস্থল পশ্চিম আফ্রিকা। সত্যিই এমন অবিশ্বাস্য এ ফুলের গড়ন। এ ফুলটি আকৃতিতে লণ্ঠনের মতো। প্রতিটি ফুলের বৃতিগুলোর সুচালো ডগা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে একটি লাল ফুল, ঝুলতে থাকে নিচমুখো হয়ে। ফুলের মধ্যে কখনোবা উঁকি দেয় সাদা রঙের পুংকেশর। সবুজ হৃৎপিণ্ডাকার পাতা, লতানো স্বভাব আর থোকাভরা ফুল সত্যি বিরল। তবে কেউ চাইলে লতার আগাগুলো ছেঁটে একে ঝোপ বানিয়ে রাখা যায়। 

সারা বছর সে ঝোপে কমবেশি ফুল হয়তো ফোটে। তবে গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফোটে বেশি। এ গাছটি বাড়ির আঙিনায় হয়ে উঠতে পারে চিরদুঃখী এক স্বপ্নকুমারী। আর বর্ষাকালে ডাল কেটে কলম করে বাড়িয়ে নেওয়া যায় গাছ। এ দেশে এই লতানো স্বভাবের শোভাবর্ধক ফুলের গাছটা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন বাগানে ছড়িয়ে পড়েছে, কেউ কেউ টবেও লাগিয়েছেন। নার্সারিতে এখন কয়েক জাতের ব্লিডিং হার্টের চারা পাওয়া যাচ্ছে। খুলনায় এক নার্সারিতে দেখেছি একটি বিচিত্র ব্লিডিং হার্টের গাছ। সে জাতের গাছের পাতা সবুজ ও সাদা রঙে চিত্রিত, কিন্তু ফুলের আকার ও রং একই। আর এক জাতের ব্লিডিং হার্টের গাছ দেখেছি, যার বৃতির রং হালকা বেগুনি।

ব্লিডিং হার্ট ভূশায়িত লতানে প্রকৃতির বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ গাছ। ৪ মিটার পর্যন্ত গাছটি লম্বা হতে পারে। পাতা অবডিম্বাকার, সবুজ ও শিরাবিন্যাস স্পষ্ট। একটি ছড়ায় অনেক ফুল গুচ্ছাকারে ফোটে। আমরা ফুলের বোঁটার কাছে যে সাদাটে ঘিয়া রঙের ত্রিকোণাকার অঙ্গ দেখি, সেটা ফুলের বৃতি। পাঁচটি বৃতি আবদ্ধ করে রাখে ফুলের পাপড়িকে। ফুল ফুটলে লাল রঙের পাপড়ি নিয়ে বৃতির বাইরে এসে ঝুলতে থাকে ফুল। পাপড়িগুলোর মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে লম্বা চিকন সুতার মতো কেশরগুলো। সাধারণত গ্রীষ্মকালে বেশি ফুল ফোটে। তবে বছরের অন্য সময়েও কিছু কিছু ফুল ফুটতে দেখা যায়। 

পতঙ্গ দ্বারা ফুলের পরাগায়ন ঘটে, এরপর হয় ফল। ফলের রং প্রথমে থাকে সবুজ, পরে হয় লাল, শেষে কালো হয়ে ফেটে বীজ ছড়িয়ে পড়ে। একটি ফলে চারটি কালো রঙের বীজ থাকে। বীজ থেকেও চারা হয়। বেশি ও ভালো ফুল পেতে চাইলে এ গাছে পর্যাপ্ত পানি ও পরিমিত সার দিতে হবে। রোদ যেখানে পড়ে, সেখানে এ গাছ ভালো হয়।

বিদ্যুতের টাওয়ারে বিপন্ন পাখির অভয়ারণ্য

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪১ পিএম
আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
বিদ্যুতের টাওয়ারে বিপন্ন পাখির অভয়ারণ্য
ছবি: লেখক

চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। এতে করে শুরুর দিকে ছায়াঘেরা নির্মল প্রকৃতিতে বাস করা কিছু বিপন্ন প্রজাতির পাখি পড়েছিল সমস্যায়। কিছু পাখি চলে গিয়েছিল এলাকা ছেড়ে। আবার কিছু পাখি বিদ্যুতের খুঁটিতেই শুরু করেছিল বাসা তৈরি করা। তবে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পাখিরা যাতে আর সমস্যায় না পড়ে তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি অভিনব সমাধান নিয়ে এসেছেন চীনের বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিভাগের কর্মকর্তারা।

উত্তর-পশ্চিম চীনের ছিংহাই প্রদেশের শানচিয়াংইউয়ান হলো চীনের অন্যতম একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনাঞ্চল। নির্মল ও বুনো পরিবেশের কারণে এটি প্রায় ৩০০ বিরল প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। এর মধ্যে ২০টিরও বেশি হলো শিকারি পাখি। এ তালিকায় আছে গোল্ডেন ঈগল, বাজপাখি এবং আপল্যান্ড বুজার্ড।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দিতে এই শানচিয়াংইউয়ানের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। যার জন্য দরকার হয়েছিল এখানে সুউচ্চ বেশ কিছু টাওয়ার নির্মাণের। আর শিকারি পাখিরাও উঁচু স্থান পেয়ে সেই টাওয়ারগুলোয় তৈরি করতে শুরু করে তাদের বাসা।

এ কাজে প্রথম দিকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল চীনের স্টেট গ্রিডের অধীনে থাকা ইউশু পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানিকে। পাখি তাড়াতে তারা প্রথমে ব্যবহার করতে শুরু করেন বিশেষ ধরনের আল্ট্রাসনিক যন্ত্র বা বার্ড রিপেলার। এতে অবশ্য কাজ হয়নি।

স্টেট গ্রিড ইউশু পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির কর্মকর্তা সু ওয়েনছি জানালেন, ‘রিপেলারগুলো প্রথম দুই বা তিন মাস কার্যকর ছিল। কয়েক মাস পরে পাখিরা এগুলোয় অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং খাপ খাইয়ে নেয়। আবার এই এলাকায় শক্তিশালী অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতির কারণে, রিপেলারগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে এবং পাখিরা সহজে সেগুলোকে ফেলে দিতে পারছে।’

সমাধান হিসেবে সঞ্চালন লাইনের কর্মীরা নিয়ে আসেন অভিনব সমাধান। পাখিদের জন্য খুঁটির আগায় তৈরি করে দেওয়া হয় নকল বাসা। সেই বাসায় তারা বসিয়ে দিলেন একখানা ছাউনি। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। নকল বাসাগুলোকেও এড়িয়ে চলতে শুরু করে পাখিরা।

প্রতিষ্ঠানটির সার্ভিস সেন্টারের কর্মকর্তা সোনাম সেরিং জানালেন, ‘প্রথম ধাপে আমরা যে বাসাগুলো তৈরি করি, সেগুলোয় ছাদ ছিল। আমরা ভেবেছিলাম এতে করে পাখিরা বাতাস ও বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের নিরাপদ ভাববে। পরে আমরা পূর্ণবয়স্ক আপল্যান্ড বুজার্ড সম্পর্কে জানতে পারি যে, তাদের পালকগুলো আসলে পানিরোধক। এতে করে যখন বৃষ্টি হয়, তখন তারা তাদের পালক দিয়েই ছানাদের সুরক্ষা দিতে পারে। আবার এ পাখিরা বেশ সতর্ক। তারা খোলা বাসায় থাকতে পছন্দ করে, যখনই কোনো বিপদের আভাস পাবে, মুহূর্তের মধ্যে যেন তারা পালিয়ে যেতে পারে।’

পাখিদের আচার-আচরণ সম্পর্কে জানার পরই বিদ্যুতের কর্মীরা প্রায় ২০০টি নকল বাসার কাঠামো বদলে দেয়। সেগুলোকে এমন স্থানে রাখা হয় যেখানে শিকারি পাখিদের অবাধ আনাগোনা রয়েছে। এতে করে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের বিপজ্জনক যে পয়েন্টগুলো রয়েছে, সেদিকে কমে আসে পাখির সংখ্যা, একই সঙ্গে কমে আসে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের হার। 

শানচিয়াংইউয়ান রিজার্ভের আকাশে এখন নিরাপদেই উড়ে বেড়াতে দেখা যায় বুনো শিকারি পাখিগুলো। 

অন্যদিকে শানতোং প্রদেশের তোংইয়িং শহরে আছে অরিয়েন্টাল হোয়াইট স্টর্ক বা অরিয়েন্টাল সাদা মানিকজোড় পাখি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের বিপন্নপ্রায় তালিকায় আছে পাখিটির নাম। ধারণা করা হয় বিশ্বে বড়জোর আর ৭ থেকে ৯ হাজার বুনো হোয়াইট অরিয়েন্টাল স্টর্ক আছে। 

অনেক উঁচুতে বাসা বানায় এরা। তোংইয়িংয়ে তারা বাসা বানানোর জন্য বেছে নিয়েছিল বিদ্যুৎ সঞ্চালনের বড় বড় টাওয়ার। 

এ পাখিদের নিয়েও এখানে চিন্তায় পড়তে হয়েছিল বিদ্যুৎ সাপ্লাই কোম্পানির কর্মীদের। যথারীতি তারাও নকল বাসা বানিয়ে সেগুলোকে স্থাপন করে টাওয়ারের ওপর। প্রথম দিকে হোয়াইট স্টর্ক পাখিরা এ নকল বাসাকে সাদরে গ্রহণ না করলেও একপর্যায়ে ধীরে ধীরে তারা এগুলোর ওপর খড়কুটো জড়ো করে বানাতে শুরু করে বাসা। 

এরপর দেখা দেয় আরেক সমস্যা। হোয়াইট স্টর্কের বিষ্ঠা পড়ে নষ্ট হতে থাকে সঞ্চালন ব্যবস্থার সরঞ্জাম। কিন্তু বিপন্ন এ পাখিদের আবাস নষ্ট হোক বা পাখিরা চলে যাক, সেটা কিছুতেই চান না কোম্পানির কর্মকর্তারা। সমস্যার সমাধানে তারা বিদ্যুতের তারের জন্য তৈরি করলেন পাখির বিষ্ঠা প্রতিরোধের উপায়।

শানতোং ইলেকট্রিক পাওয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক লিউ হুই জানালেন, যে বস্তুটি তারা তৈরি করেছেন সেটার নাম কম্পোজিট ইনসুলেশন অ্যান্টি-বার্ড-ড্রপিংস কভার। এর প্রধান কাজ হলো তার বা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশে পাখির বিষ্ঠার পতন ঠেকানো।

মোটকথা, প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ফেলে কখনোই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষপাতি নয় চীন। আর তাই এখন তোংইয়িংয়ের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের টাওয়ারগুলোর ওপর বেশ আরামেই ঘর সংসার করছে দুই শতাধিক অরিয়েন্টাল হোয়াইট স্টর্ক পরিবার। এদের মধ্যে ৭০টিরও বেশি বাসায় বড় হতে চলেছে বিপন্ন এ পাখির পরবর্তী প্রজন্ম। 

লেখক: সংবাদকর্মী

হাসে ওই লাল শাপলা ফুল

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩১ এএম
হাসে ওই লাল শাপলা ফুল
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার রৌমারী ইউনিয়নের পাটা ধোয়া বিলে ফুটেছে লাল শাপলা ফুল। খবরের কাগজ

শরতের নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ। বিলে হাসে টকটকে লাল শাপলা ফুল। এখানে বয়ে যায় নির্মল বাতাস। এতে শাপলার সবুজ পাতাগুলো প্রায়ই উল্টে যায়। আর ফুলগুলো দুলতে থাকে। সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব দৃশ্যের। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন আসেন অনেকে। এই ফুলের মেলায় কিছুটা সময় আনন্দে কাটান। ছোট ছোট নৌকায় ঘুরে বেড়ান তারা। হাত বাড়িয়ে তোলেন শাপলা ফুল। কেউ কেউ মালা তৈরি করে গলায় পরেন। ছবি তোলেন।

এই লাল শাপলার বিলের অবস্থান কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার রৌমারী ইউনিয়নের মাদারটিলা এলাকায়। এর নাম পাটা ধোয়া বিল। বিলের অদূরে ব্রিটিশদের নীলকুঠি। এই নীলকুঠির পাশে দেওকুড়া বিল। নিচু এই এলাকায় একসময় প্রচুর পাট চাষ হতো। পাট জাগ দেওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল বিলটি। পাটচাষিরা ওই বিলে পাট জাগ দিতেন। পাট নরম হলে আঁশ ছাড়ানো হতো। পাটের আঁশ ছাড়ানোকে এই অঞ্চলের মানুষরা বলেন পাটা ধোয়া। অনেকের ধারণা, এ থেকে বিলটির নাম হয় পাটা ধোয়া বিল। তবে এখন অনেকে লাল শাপলার বিল হিসেবেই একে চেনেন।

উপজেলা শহর থেকে বিলটির দূরত্ব সাত কিলোমিটার। রৌমারী-ঢাকা সড়কের কর্তিমারী বাজার। বাজারের শুরুতে পুব দিকে চরনতুনবন্দর সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার এগোলে বাম পাশে চোখে পড়ে বিলটি। কৃষকদের শত একরের বিলটি এখন পর্যটন এলাকা। জুলাইয়ের শুরুতে লাল শাপলা ফুল ফুটতে শুরু করে বিলটিতে। অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচুর ফুল দেখা যায়। প্রতিদিন কাছের ও দূরের মানুষ আসেন লাল শাপলা দেখতে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল আমিন স্থানীয় বন্ধুদের নিয়ে বিল দেখতে এসেছেন। নৌকায় ঘুরছেন। ছবি-সেলফি তুলছেন। হইহুল্লোড় করছেন। নৌকায় গলা ছেড়ে গানও গাইছেন তারা। আল আমিন জানান, একটু দূরে তাদের বাড়ি। হল বন্ধ হওয়ার পর ঢাকা থেকে এসেছেন। বন্ধুদের নিয়ে বিলে এসে তিনি অবাক। বলেন, ‘এখানে প্রকৃতি এত সুন্দর! বুঝতেই পারিনি। মন ভালো হওয়ার মতো জায়গা। সবার বেড়াতে আসা উচিত।’ 

কাউনিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনটি নৌকায় ঘুরছেন শিক্ষকরা। সবার হাতে গোছা গোছা শাপলা। শিক্ষকরা বলেন, ‘আশপাশের সবাই বিলের লাল শাপলা ফুল দেখতে আসে। যাওয়ার সময় হাতে শাপলা তুলে নিয়ে যায়। এসব দেখে শিক্ষার্থীরা বলছিল দেখতে আসবে। তাই নিয়ে এসেছি। তারা খুব আনন্দ করছে। আমাদের ভালো লাগছে।’ 

শিক্ষার্থী সুমাইয়া বলে, ‘সবাই মিলে এসেছি। অনেক ভালো লাগছে। আমরা আবার আসব।’ শিক্ষার্থী রাব্বী বলে, ‘খুব মজা হচ্ছে। এত সুন্দর জায়গায় কখনো আসিনি।’

রফিকুল ইসলাম এসেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে ঘুরছেন বিলে। রফিকুল বলেন, ‘প্রকৃতির রূপ সত্যিই অসাধারণ। আমি আগেও এসেছি। এবার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এসেছি। তারা খুব খুশি হয়েছে। বিলের পাশে একটু বসার জায়গা থাকলে আরও ভালো হতো। কিছু দোকানপাট দরকার।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিলটি অনেক পুরোনো। তবে পাঁচ বছর ধরে এখানে লাল শাপলা ফুল ফুটছে। ওমর আলী নামের একজন বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফুলের সংখ্যা বেশি। প্রতিদিন শত শত লোক দেখতে আসছে। তিনি জানান, বিলের জমির মালিকরা লোকসান গুনছেন। এক মৌসুম ফসল ফলাতে পারছেন না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

আনিছুর রহমান বলেন, কৃষকদের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। তবে ইতোমধ্যে বিল ঘিরে বাড়তি আয়ও করছেন অনেকে। 

ভোরে নৌকা নিয়ে প্রস্তুত থাকেন মাঝি ফরহাদ আলী। তিনি বলেন, দিনে ৭০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন একজন মাঝি। তবে শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় লোকজন বেশি আসে। আয়ও বেশি হয়। গত শুক্রবার দর্শনার্থী ঘুরিয়ে তিনি আয় করেন ১ হাজার ৮০০ টাকা। ওই দিন ১৬টি নৌকার আয় হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। মাঝি সুরুজ্জামান জানান, পরিবার-পরিজন নিয়ে বিলে ঘুরতে আসেন অনেক মানুষ। নৌকায় উঠে বিল ঘুরে ঘুরে শাপলা তোলেন। 

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বিলটি দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে খেয়াল রাখছে পুলিশও। 

রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘আমাদের লোকজন প্রায়ই ঘুরে আসেন। যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে।’

রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ হাসান খান বলেন, বিলটি নিয়ে প্রশাসন ভাবছে। যাতে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খুড়ুলে প্যাঁচার পরকীয়া

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১১ এএম
আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১১ এএম
খুড়ুলে প্যাঁচার পরকীয়া
খুড়ুলে প্যাঁচা

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে দেখলাম প্রাচীন দেয়ালের কোটরে আজও কয়েক জোড়া খুড়ুলে প্যাঁচার সংসার টিকে আছে। কোটরের মুখে নির্ভয়ে বসে প্যাঁচাগুলো আমাদের আনাগোনা দেখছে। ওরা জানে, কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বিহারে উঠে আমরা ওদের বিরক্ত করতে পারব না। বলাবাহুল্য, নিশ্চিন্ত ওই নিশাচরদের নির্বিকার দৃষ্টির সামনে আমরা কিঞ্চিৎ বিমূঢ় হলাম। পেঁচকের অমন নিরুদ্বিগ্ন অবয়বের নেপথ্যে না জানি অতীতের কত ইতিহাস জমে আছে!

অষ্টম শতাব্দীতে ওদের পূর্বপুরুষরা এ বিহারের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী ধর্মপাল দেবকে এখানে পদধূলি দিতে দেখেছে। তারপর হাজার বছর বয়ে গেছে এবং শূন্য বিহারে জমেছে ধূলিমাটি; কিন্তু বংশপরম্পরায় প্যাঁচার বসতি ঠিকই টিকে গেছে। তাই উনিশ শতকে ওদের নিকটাত্মীয়রা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখেছে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারের অধিনায়ক মেজর জেনারেল অ্যালেকজান্ডার ক্যানিংহাম যখন পাহাড়পুরে এলেন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য শুরু করার প্রবল বাসনা বুকে নিয়ে।

খুড়ুলে প্যাঁচার কাছে ধর্মপাল, বৌদ্ধ ভিক্ষু, ক্যানিংহাম কিংবা আমাদের মতো অজ্ঞাতকুলশীল পর্যটক, সবই এক। মানুষ এলেই ওরা খুশি। ওরা জানে যে মানুষ এলে বর্জ্য আসে এবং বর্জ্য এলেই আসে ইঁদুর-ছুঁচো ও ঝিঁঝিঁ-তেলাপোকারা। মূষিক মাত্রই পেঁচক-কুলের প্রিয় আহার্য; তদুপরি তেলাপোকাগুলো খুড়ুলে প্যাঁচার অতিশয় পছন্দসই খাবার। বিশেষ করে ছোট্ট ছানার মুখে তেলাপোকা তুলে দেওয়ার দুর্বার আগ্রহ ওদের। তেলাপোকার তেলেই সম্ভবত ছানাদের বেশি শ্রীবৃদ্ধি হয়। প্রতি শীতে প্রজনন হলেও অধিকাংশ পাখির মতোই ওদের ৮০ শতাংশ ছানা সাবালক হওয়ার আগেই অনাহারে ও অপঘাতে মারা যায়। তাই ১৫ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বংশধারা রক্ষার জন্য ওরা প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়; এবং যুগ যুগ ধরে সে কাজে সফলকামও হয়েছে। 

ধর্মপালের বংশলতিকা লুপ্ত হয়েছে, অনূঢ় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তো বংশ প্রতিষ্ঠাই করেনি এবং ক্যানিংহাম ও তার সুযোগ্য পুত্ররা ফিরে গেছেন আপন দেশে; কিন্তু খুড়ুলে প্যাঁচারা আজও পাহাড়পুরে রয়ে গেছে। অনাদিকাল থেকে বংশধারা রক্ষায় নিবেদিত রয়েছে খুড়ুলে প্যাঁচার পুরো জীবন। একবার জোড়া বাঁধলে ওরা আর জোড়া ভাঙে না; যদিও এ দেশের অন্যান্য পাখি প্রতিবছর নতুন জোড়া বাঁধে। নতুন বছরে নতুন জোড়া বাঁধলে ‘ইনব্রিডিং’ বা অন্তঃপ্রজনন কম ঘটে এবং জিনভিত্তিক রোগ ও বিকৃতির আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে আজীবন জোড়া-বাঁধা এই প্যাঁচাদের মধ্যে অমন রোগ ও বিকৃতি বেশি নেই। কৌতূহলী পাখি বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালিয়ে ইতোমধ্যে রহস্যভেদ করেছেন। রহস্যটা হলো এই যে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বস্ত স্ত্রী প্যাঁচারা আসলে পরকীয়ায় বেশ পটু। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ৩০ শতাংশ প্যাঁচার বাসায় একাধিক পুরুষের ছানা রয়েছে। সন্দেহ নেই, পোকা শিকারের নামে রাতের আঁধারে অনেক প্যাঁচা-বধূ অভিসারে যায়। পরকীয়া শব্দটি কটু হলেও সেটি অন্তঃপ্রজননের অভিশাপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী এক রক্ষাকবচ। 

খুড়ুলে প্যাঁচা মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাখি। বাংলাদেশের পশ্চিমে ইরান ও পূর্বে ভিয়েতনাম পর্যন্ত এর বসবাস। আট ইঞ্চি দীর্ঘ এই নিশাচর পাখির ইংরেজি নাম ‘স্পটেড আউলেট’। ইউরোপে এর অস্তিত্ব না থাকলেও একজন ফরাসি বিজ্ঞানী প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই ঈশ্বরের নামে পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন ‘এথেনা ব্রহ্মা’। এথেনা ছিলেন জ্ঞান, শিল্পকলা ও যুদ্ধের ঈশ্বরী এবং ব্রহ্মা হলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। তবে আমাদের কাছে সে ছিল শ্মশান, গোরস্তান ইত্যাদি স্থানের বিনিদ্র প্রহরী। বলতে পারি না, পরকীয়ার বিষয়টি জানার পর ওদের জন্য আমাদের ভালোবাসা কমবে না বাড়বে!

নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪২ এএম
নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুক
বলধা উদ্যানে শরতে ফোটা নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুক ফুল। ছবি: লেখক

শালুক আর শাপলা নিয়ে আমাদের যে বিভ্রান্তি রয়েছে, তা জেমস টেইলরের টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা বইটি পড়লে কেটে যায়। এ বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৪০ সালে। সে বইয়ে তিনি ঢাকার শাপলা-শালুক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঢাকার জলাভূমিতে জলজ লিলি জন্মে। এসব উদ্ভিদের গোড়ায় যে মোথা বা কন্দ হয় তাকে বলে শালুক এবং মোথা থেকে পানির মধ্য দিয়ে যে লম্বা নলের মতো পাতা ও ফুলের বোঁটা জন্মে, বোঁটার মাথায় ফুল ফোটে, ফল হয় ও ফলে বীজ হয়, একে বলে শাপলা।

শাপলা ও শালুক ঢাকার বাজারে বিক্রি হয়, যা সেখানকার মানুষরা খায়। শুকনো মৌসুমে জলাশয় শুকিয়ে গেলে মানুষরা মাটি চষে সেসব মোথা তুলে সেদ্ধ করে খায়। শালুক স্টার্চ বা শ্বেতসার উৎপাদনের উত্তম উৎস। সেসব শালুক থেকে স্থানীয় বৈদ্যরা অ্যারো-রুট (লোকেরা বলে অ্যারারুট) তৈরি করেন। এর বীজ ভেজে খই বানানো হয়।’ জেমস টেইলর ছিলেন তৎকালীন ঢাকার সিভিল সার্জন ও চিকিৎসক। তার লেখনীতে শাপলা ও শালুকের যে পরিষ্কার প্রভেদ ফুটে উঠেছে, তা একালের অনেকেরই অজানা।

নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা তার বলধার ছিন্নস্মৃতি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এম আহমেদ আমাদের দেশে অনেক দিন পর পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ভিক্টোরিয়া অ্যামাজোনিকা (আমাজন লিলি) চাষে সফল হন এবং বলধাকে কয়েকটা চারা উপহার দেন। বলধার নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুক (Nymphaea capensis) প্রজাতিটিও তারই দেওয়া।’ 

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন তার বাংলাদেশের পুষ্প-বৃক্ষ-লতা-গুল্ম বইয়ে শালুকের প্রজাতিগত নাম উল্লেখ করেছেন Nymphaea nouchali. কেউ কেউ একে প্রজাতিগত সমনাম হিসেবে বলছেন। এ প্রজাতির ফুলের রংও গাঢ় নীল বা হালকা নীল, এ দেশের অনেক স্থানে একে ফুটতে দেখা যায়, বিশেষ করে মৌলভীবাজার, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও উপকূলীয় অঞ্চলে। ফুল বড় আকারের ও পাঁপড়িগুলো একটু খাড়া, ফুল সুগন্ধি। এটি শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুল। বলধা গার্ডেনের নীল-বেগুনি ফুলের পাপড়ি গাঢ় রঙের, ফুল বড়, পূর্বোক্ত প্রজাতির মতো পাপড়িগুলো ওভাবে খাড়া না, অনেকটা শায়িত ও ছড়ানো, মাঝখানে জননকেশরগুলোর বিন্যাসেও পার্থক্য আছে। এ বিষয়ে আরও গবেষণা করা যেতে পারে।

দুর্লভ সেই নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুকের দেখা পেলাম বলধা উদ্যানের সাইকি অংশে গিয়ে। শরতের সকালে উজ্জ্বল রোদে নীল-বেগুনি রঙের ফুলের হাসি ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। পাপড়ির যে রং চাক্ষুষ করলাম, সে রং না ধরা যাবে আলোকচিত্রে, না আঁকতে পারবে পৃথিবীর কোনো শিল্পী। প্রকৃতির রংকে কোনো তুলিতেই হুবহু প্রাণবন্ত করে তোলার ক্ষমতা প্রকৃতিমাতা কোনো শিল্পীকে বোধ হয় দেননি, যন্ত্রকে তো নয়ই। তবু চেষ্টা করলাম সে আভাময়ী ফুলের ছবিটা তোলার। আভাময়ী বলছি এ কারণে যে ফুলের মাঝখানে খাড়াভাবে থাকা পরাগকেশরগুলো যেন জ্বলন্ত উনুনের লাকড়ি, মাঝখানে বৃত্তাকার জায়গাটায় উজ্জ্বল হলুদ রং এমনভাবে আভা ছড়াচ্ছে যেন ওটা জ্বলন্ত কোনো চুল্লি। সে আগুনে জায়গাটায় উড়ে উড়ে আছড়ে পড়ছে মৌমাছিরা। পায়ে-শুঁড়ে পরাগরেণু মেখে ফুলের পরাগায়ন ঘটাচ্ছে ও ফুলকে ফলবতী হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। মৌমাছিরা লুটে নিচ্ছে ফুলের মধু। প্রকৃতির এই পারস্পরিক লাভের কথা ফুল আর মৌমাছিরাই ভালো জানে।

নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুকই কি প্রাচীনকালের নীল পদ্ম? রামায়ণের রামচন্দ্র দেবী দুর্গার পূজার জন্য কোথায় পেয়েছিলেন ১০৭টি নীল পদ্ম? জানা নেই। কথিত যে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে প্রাচীনকালে নীল পদ্ম জন্মাত। নীল পদ্ম মিসরীয় সংস্কৃতিতে সৃষ্টি ও পুনর্জন্মের প্রতীক হিসেবে পবিত্র। প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, পৃথিবী মূলত জল ও অন্ধকার দ্বারা আবৃত ছিল, সে জলেই ফুটত নীল পদ্ম। নীল পদ্ম ছিল মিসরের রাজশক্তির প্রতীক। এসবই এখন কিংবদন্তি। প্রকৃতপক্ষে শাপলা ও পদ্মের মধ্যে গোত্রগত কোনো মিল নেই। শাপলা বা শালুক Nymphaeaceae গোত্রের, আর পদ্ম Nelumbonaceae গোত্রের। দুটিই জলজ বিরুৎ শ্রেণির উদ্ভিদ, কিন্তু পদ্মের পাতা বৃত্তাকার, শাপলার পাতা বৃত্তাকার থেকে ডিম্বাকার হলেও বোঁটার কাছে হৃৎপিণ্ডাকারে কাটা। দুটি ফুলের পাপড়ির আকার-আকৃতিরও পার্থক্য আছে, রঙে তো বটেই। পদ্মের সম্পর্ক সূর্যের সঙ্গে, শাপলার সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। এ জন্য শালুকের আরেক নাম কুমুদ।

নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুকের গাছ বহুবর্ষী কন্দজ বিরুৎ। পাতা বৃত্তাকার ও উজ্জ্বল সবুজ, বোঁটার কাছে পত্রফলক চেরা, কিনারা অনিয়তভাবে ঢেউ খেলানো। ফুল পানিতল থেকে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে ফোটে। বৃতি চারটি, বৃতির রং সাদা লম্বা রেখাযুক্ত সবুজ বা লালচে সবুজ। সম্পূর্ণ ফোটা ফুলের পাপড়ির বিস্তার ৮ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার, পাপড়ির সংখ্যা ১২ থেকে ২৪টি, রং নীল-বেগুনি বা বেগুনি, পুরুষ কেশর থাকে ১০০ থেকে ২০০টি, রং বেগুনি, ফুলের কেন্দ্রস্থল চাকতির মতো। বর্ষা থেকে হেমন্ত ফুল ফোটার সময়। বীজ হয়, বীজ থেকে চারা জন্মে। গোড়ার মোথা থেকেও চারা হয়।

তিন মাস পর দুয়ার খুলছে সুন্দরবনের, চলছে প্রস্তুতি

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০২:২৭ পিএম
আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০৩:২৪ পিএম
তিন মাস পর দুয়ার খুলছে সুন্দরবনের, চলছে প্রস্তুতি
দীর্ঘ বিরতির পর সুন্দরবনের ভেতরে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ছবি: খবরের কাগজ

সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় টানা তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার পর রবিবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। দীর্ঘ বিরতির পর সুন্দরবনের ভেতরে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোতে। এ দিন থেকে অনুমতি নিয়ে পর্যটক ও বনজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছেন সুন্দরবনসংলগ্ন বনজীবী ও ট্যুর অপারেটররা।

দীর্ঘদিন পর আয়-রোজগারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক পেশাজীবীদের মধ্য স্বস্তি ফিরে এসেছে। কেউ নতুন করে জাল বুনছেন, কেউ পুরোনো জাল মেরামত করছেন। আবার কোথাও চলছে নৌকা-ট্রলার প্রস্তুতের শেষমুহূর্তের কাজ।

বন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে গত ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ। রবিবার থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।

মোংলা ট্যুর অপারেটর মো. এমাদুল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিন মাস বন্ধ থাকার পর রবিবার থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হচ্ছে। ট্যুরিস্টদের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। বুকিং পেলে রবিবার থেকে ট্যুরিস্টদের নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারব। দেশের বিভিন্ন স্থানের বন্যার প্রভাব আমাদের মোংলায়ও পড়বে। কেননা, যারা ভ্রমণে আসবেন তাদের অনেকেই এখন বন্যার কবলে। তাই গতবারের তুলনায় এবার যাত্রীর আশঙ্কা খুবই কম।’

বনজীবী মাছুম বলেন, ‘আমাদের এলাকার বহু মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় ইতোমধ্যে স্থানীয় জেলেরা বন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাস নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছেন। রবিবার ভোরেই আমরা সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা হব।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মো. নূর আলম শেখ বলেন, ‘দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর খুলছে সুন্দরবন। এ সময় যেন কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা না হয়। সুন্দরবনের খালে বিষ প্রয়োগে মাছ নিধন না হয়। আশা করি, চোরাকারবার বন্ধ রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকবে।’

সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘বনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা, বন্যপ্রাণী এবং নদী-খালে মাছের বিচরণ ও প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। আগামী রবিবার নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হবে। রবিবার থেকে বনজীবী ও ট্যুরিস্টরা নিয়ম মেনে অনুমতিসাপেক্ষে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। আমরা বনজীবী ও ট্যুরিস্টদের সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছি।’

সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘সুন্দরবন জল-স্থলভাগ শুধু জীববৈচিত্র্যেই নয়, মৎস্যসম্পদের আধার। সে কারণে প্রথমে সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ইন্ট্রিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানিংয়ের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ২০২২ সাল থেকে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সময় বৃদ্ধি করে বন মন্ত্রণালয়। এ সময় সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ ধরা বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।’

রিফাত মাহামুদ/ইসরাত চৈতী/অমিয়/