নাম মেছোবাঘ। দেখতে বাঘের মতো হলেও মূলত এটি বিড়ালগোত্রীয় প্রাণী। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেছোবাঘ কম বেশি দেখা গেলেও হাওর অঞ্চলে এদের দেখা যায় বেশি। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে এই প্রাণীটির বিচরণ বেশি। বিভিন্ন অঞ্চলে মেছোবাঘ বিভিন্ন নামে পরিচিত। অনেক অঞ্চলে মেছোবিড়াল, ছোট বাঘ, বাঘরোল বা বাঘুইলা নামে এটি পরিচিত। এদের গায়ে ছোপ ছোপ দাগ থাকায় চিতাবাঘ বলেও ভুল করে থাকেন অনেকে।
মেছোবাঘ মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী। এটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়। মেছোবাঘের বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus বা Felis viverrina। ইংরেজি নাম Fishing Cat। এরা নিশাচর। ব্রাজিল, কোস্টারিকা, বাংলাদেশ, ভারত, বলিভিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, শ্রীলঙ্কায় এরা স্থানীয়ভাবে বাঘরোল নামে পরিচিত। মেছোবাঘের আদি আবাসস্থল থাইল্যান্ড ও এল সালভাদরে।
বাংলাদেশে মেছোবাঘ সাধারণত জলাভূমি, নদীর প্রবাহ, অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ, জলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভে বাস করে। এদের উপস্থিতি সেখানকার জলাভূমির অবস্থার ভালো-মন্দ নির্ধারণে সাহায্য করে। এরা সাঁতারে পারদর্শী হওয়ায় এ ধরনের পরিবেশে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে।
মেছোবাঘের প্রধান খাবার মূলত মাছ। এ ছাড়া কাঁকড়া, শামুক, মুরগি, হাঁস, ছাগল, ভেড়াও এই প্রাণীর খাদ্য তালিকায় রয়েছে। মাছ ধরার জন্য মেছোবাঘ বা মেছোবিড়াল পানিতে নামে না। পানির ওপর কোনো গাছের ডালে বা পানির ওপর জেগে থাকা কোনো পাথরে বসে থাবা দিয়ে শিকার ধরে। তবে খুব খাদ্যাভাব দেখা দিলে মেছোবাঘ মানুষের ওপরও আক্রমণ করে থাকে। তবে এরা হিংস্র হলেও খুব ভীতু প্রকৃতির প্রাণী।
এরা আকারে গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে অনেকটা বড় হয়। শরীর ঘন, পুরু লোমে আবৃত। পুরুষ মেছোবিড়াল আকারে স্ত্রী মেছোবিড়ালের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এদের চেহারা ও গায়ের ডোরা অনেকটা বাঘের মত। মেছোবিড়াল লেজসহ লম্বায় সাড়ে তিন ফুটের মতো হয়ে থাকে। সামান্য হলুদ মেশানো ধূসর রঙের চামড়ায় মোটামুটি লম্বালম্বিভাবে কয়েক সারি গাঢ় হলুদ ডোরা থাকে। পেটের নিচের রং সাদাটে। এদের কান ছোট এবং গোলাকার হয়। চোখের পেছন থেকে গলার শেষ পর্যন্ত ৬ থেকে ৮টি কালো বর্ণের ডোরাকাটা দাগ থাকে। পুরো শরীরে ছোপ ছোপ কালো দাগ আছে।
১৫ মাস বয়স হলে এরা প্রজনন উপযোগী হয়। সাধারণত মার্চ মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত এদের প্রজননের সময়। একসঙ্গে একাধিক বাচ্চা প্রসব করে থাকে মেছোবাঘ। এদের গড় আয়ু ১০ বছর।
বিভিন্ন কারণে গত কয়েক দশকে মেছোবাঘের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো মেছোবাঘের প্রতি মানুষের হিংসাত্মক মনোভাব ও ভ্রান্ত ধারণা।
বিশিষ্ট প্রাণিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘মেছোবাঘ একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। বাংলাদেশে কতগুলো মেছোবাঘ আছে এই সংক্রান্ত কোনো সার্ভে বা জরিপ আমাদের করা হয়নি। তবে দিন দিন বিভিন্ন সংকটের কারণে এই প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মাছ এদের প্রধান খাদ্য হওয়ায় এরা মূলত বিভিন্ন জলাশয় যেমন, টাঙ্গুয়ার হাওর, রাজশাহীর চলনবিল, শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর, বাইক্কার বিল এলাকায় বসবাস করে। কিন্তু এই এলাকাগুলোতে মাছ ধরার জন্য পাতা ফাঁদ, কারেন্ট জালে আটকে মারা যায় মেছোবাঘ। আবার এদের আবাসস্থল, ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল বা অভয়ারণ্য ধ্বংস করে ফেলায় এরা বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে প্রজাতিটি একটি সংরক্ষিত প্রাণী। বাইক্কার বিলে ৫১ থেকে ৫৪টি বিল আছে, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে এদের অভয়ারণ্য রয়েছে কিছু জায়গায়। তবে এদেরকে বসবাসের পরিবেশ না দিলে এরা টিকবে কীভাবে? তাই শুধুমাত্র জনসচেতনতা নয় বরং আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অভয়ারণ্য রক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।’
এক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৪৫ শতাংশ অভয়ারণ্য এবং বিশ্বের ৯৪ শতাংশ জলাশয় ধীরে ধীরে মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল মুছে গেছে। ভারতের বণ্যপ্রাণী ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ড ফর নেচার ইন্ডিয়ার (ডব্লিউডব্লিউএফ) তথ্য মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০ হাজারের মতো মেছোবাঘ টিকে আছে।
তবে বনাঞ্চল বা আবাসস্থল ধ্বংস করে জনবসতি স্থাপন ও কৃষিজমিতে রূপান্তর, হাওর ভরাট, মানুষের অসচেতনতা ও ভ্রান্ত ধারণা, খাদ্যসংকট ইত্যাদি কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
একদিকে হাওরাঞ্চলে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় খাদ্যাভাবে মেছোবাঘ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে মানুষ বাঘ মনে করে অনেক মেছোবাঘ হত্যার কারণেও এর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জলাশয় ভরাট এবং বন উজাড়ের কারণে এদের আবাসস্থল বিরাট হুমকির মুখে পড়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এই প্রাণী।
তাই ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০০৮ সালে মেছোবাঘকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
বাংলাদেশের ১৯৭৪ ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
মেছোবাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার জনসচেতনতা। আমাদেরকে পরিবেশ দূষণ রোধে কাজ করতে হবে। কারেন্ট জালের ব্যবহার কমাতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এটিকে সেই রাজ্যের ‘রাজ্য প্রাণী’ তকমা দেওয়া হয়েছে এবং এই রাজ্য বর্তমানে বাঘরোল সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। যা মেছোবাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিরাট অবদান রাখছে।