ঢাকা ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪

পাহাড়কোলে কাশ্মীর দোপাটি

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫৫ এএম
আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
পাহাড়কোলে কাশ্মীর দোপাটি
ছবি: লেখক

চলছে আষাঢ় মাস, নামছে বাদল ধারা। সিলেটের খাদিমনগর উপশহরে টিলার ওপরে শুকতারার একটি ঘরে বসে পয়লা আষাঢ়ের রাতটা কাটল অঝোর ধারার বৃষ্টির সঙ্গে। ভোর সাড়ে চারটে, বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। রাতে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে হাঁটতে হাঁটতে যাব খামিদনগর ইকোপার্কে, কিছু গাছপালার সঙ্গে মিতালি করতে। কিন্তু বৃষ্টি সে ইচ্ছেয় বাদ সাধল। 

ভোরের আলো ফুটতেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি টিলার নিচে নিচু জায়গাগুলো জলে ভরে আছে, তবে বৃষ্টিটা থেমেছে। তাই হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। উপশহরের রাস্তা আর টিলার প্রান্তে কিছু ঝোপের ভেতর যেন টুকরো টুকরো গোলাপি-সাদা চুনি-পান্না জ্বলছে। সাদা ফুলগুলো বুনো টগর, কিন্তু গোলাপি ফুলগুলো কী?

টিলার প্রান্তে নর্দমার ধারে জলসিক্ত গাছগুলোতে ফুটে আছে অজস্র ফুল। ফুল দেখে প্রথম দোপাটি মনে করে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে যখন একটা ঝোপের কাছে এসে পড়লাম, তখন সে ভুল ভাঙল- ওগুলো দোপাটি ফুল, তবে আমরা বাগানে যে দোপাটি ফুলের গাছ লাগাই, সে দোপাটি না। বাগানের দোপাটি গাছের কাণ্ড গিঁটযুক্ত, পাতা ছোট ও সরু, কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা এবং ফুল লাল, গোলাপি, সাদা। কিন্তু এই দোপাটি গাছের পাতা বেশ বড়, চওড়া ও আয়ত-ডিম্বাকার, অগ্রভাগ সুচালো, কিনারা সূক্ষ্মভাবে খাঁজকাটা। 

গাছের মাথার দিকে পাতার কোল থেকে সরু লম্বা বোঁটায় কয়েকটা করে ফুল ফুটেছে। পাপড়িগুলো বোয়াল মাছের মতো হাঁ করে আছে। ওপরের পাপড়িটি প্রায় সাদা, নিচের পাপড়ি দুটো গোলাপি। হাঁ করা ফানেলের মতো পাপড়ির গহ্বরের ভেতরে শোভা পাচ্ছে ফুলের হলদে জননাঙ্গগুলো। ফুলের পরাগায়ন ঘটে পোকাদের মাধ্যমে। ফুল ফোটে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। দেখলাম, ডালের নিচের দিকের ফুলগুলো ঝরে গেছে, সেখানে সরষে ফলের মতো সবুজ ফল গঠিত হয়েছে। সচরাচর দোপাটি ফুলের ফলগুলো হয় ডাম্বেল বা মাকুর মতো উপবৃত্তাকার, আর ফল সরু কাঠির মতো। এ রকম বনে ও পাহাড়ের কোলে রাস্তার ধারে কারও এসব গাছ লাগানোর কথা না। আশপাশে তাকাতেই আরও গাছ চোখে পড়ল। একেবারে আগাছার মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই টিলার বন-পাহাড়ে।  

ঢাকায় এসে বইপত্র ঘেঁটে এ গাছের পরিচয় পেলাম কাশ্মীর দোপাটি, ইংরেজিতে বলে হিমালয়ান বালসাম। ফুল দেখতে কিছুটা অর্কিডের মতো, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো কেউ কেউ একে বলেন গরিবের অর্কিড। কাশ্মীর দোপাটি কখনো কারও বাগানে ঠাঁই পায়নি, সে রয়ে গেছে জঙ্গলের আগাছা হয়েই। এ গাছ হিমালয় অঞ্চলের, কাশ্মীরে বেশি দেখা যায় বলে এর নাম কাশ্মীর দোপাটি। হয়তো হিমালয় থেকে আসাম ঘুরে এই বনফুলের গাছ এসেছে সিলেটের পাহাড়ে-টিলায়। কখন কীভাবে এসেছে জানি না, তবে আগাছা হিসেবে যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর সে পাহাড়ের চৌহদ্দিতে আর থাকবে না- একপর্যায়ে দেশের অন্যত্রও দেখা যাবে আশা করি। 

কাশ্মীর দোপাটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Impatiens balfourii ও গোত্র বালসামিনেসী। এ গাছের পাকা ফল কারও হাতের সামান্য ছোঁয়াও সহ্য করতে পারে না, ছুঁলেই ফেটে যায়। বেশি পেকে শুকানো শুরু করলে স্পর্শ না করলেও ফল ফেটে বীজ প্রায় ৬ মিটার দূর পর্যন্ত মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানেই চারা গজিয়ে ওঠে। এ জন্যই এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক লাতিন নামের প্রথম অংশ ইমপ্যাটিয়েন্স রাখা হয়েছে, যার অর্থ বিদারী, দ্বিতীয় অংশ বালফোরি রাখা হয়েছে স্কটিশ উদ্ভিদবিদ আইজ্যাক ব্যালে বালফোরের নামানুসারে। কাশ্মীর দোপাটির গাছ বর্ষজীবী বিরুৎ প্রকৃতির, গাছ ১৫ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, কাণ্ড লালচে ও শাখায়িত। ওপর থেকে দেখলে ছোট-বড় পাতার আলপনার মতো বিন্যাসটা বেশ সুন্দর দেখায়। সাধারণত পাহাড়ের কোলে, রাস্তার ধারে, নর্দমার পাশে, পতিত জমিতে আগাছা হিসেবে এ গাছ জন্মে। কাশ্মীর দোপাটির আদি বাসভূমি হিমালয় অঞ্চল হলেও উনিশ শতকে তা ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।

হাটহাজারীতে ১১ ফুট লম্বা অজগর উদ্ধার

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৬ পিএম
আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪, ০২:১৯ পিএম
হাটহাজারীতে ১১ ফুট লম্বা অজগর উদ্ধার
ছবি: খবরের কাগজ

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় ১১ ফুট লম্বা একটি অজগর উদ্ধার করেছেন বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ টিমের সদস্যরা।

শনিবার (৬ জুলাই) রাত ১২টার দিকে উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড থেকে অজগরটি উদ্ধার করা হয়।

জানা যায়, ওই এলাকার যুবক ফরহাদ এশার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার পাশে সাপটি দেখতে পান। প্রথমে তিনি ৯৯৯-এ ফোন দেন। পরে পুলিশ তাকে স্থানীয় বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়। পরে বন বিভাগকে জানালে তারা বিষয়টি বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ টিমকে জানায়। এরপর তারা অজগরটি উদ্ধার করে। 

বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ টিমের সদস্য রেজাউল করিম রাকিব খবরের কাগজকে বলেন, ‘খবর পেয়ে রাত ১২টার দিকে সাপটি উদ্ধার করি। সাপটি লম্বায় ১১ ফুট। ওজন প্রায় ১৩ কেজি। পাহাড়ি ঢল বা খাবারের খোঁজে সাপটি লোকালয়ে এসেছে বলে ধারণা করছি।’

রবিবার (৭ জুলাই) বিকেলে বন বিভাগের সহায়তায় সাপটি গহিন অরণ্যে অবমুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।

তারেক মাহমুদ/ইসরাত চৈতী/অমিয়/

শ্রীমঙ্গলে আহত বনবিড়াল উদ্ধার

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৩:০৫ পিএম
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৩ পিএম
শ্রীমঙ্গলে আহত বনবিড়াল উদ্ধার
ছবি: খবরের কাগজ

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আহত অবস্থায় একটি বনবিড়াল উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন।

শনিবার (৬ জুলাই) দুপুরে শ্রীমঙ্গল শহরের শ্যামলী আবাসিক এলাকা থেকে আহত বনবিড়ালটি উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল জানান, শ্যামলী আবাসিক এলাকায় একটি বাসার ছাদে কবুতর খেতে এসে ছাদ থেকে পড়ে বনবিড়ালটি আহত হয়। পরবর্তীতে ওই এলাকার রুবেল মিয়া বনবিড়ালটিকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখতে পেয়ে আমাদেরকে খবর দিলে আমরা বনবিড়ালটিকে উদ্ধার করে বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর করি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গলের রেঞ্জার শহিদুল ইসলাম জানান, আহত বনবিড়ালটিকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার পর প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হবে।

হৃদয় শুভ/সাদিয়া নাহার/অমিয়/

শহুরে শিকারি লালমাথা শাহিন

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৪ পিএম
শহুরে শিকারি লালমাথা শাহিন
ছবি: লেখক

পুরান ঢাকায় বিদ্যুৎ-পাইলনের গরম ইস্পাতে স্থির বসে রয়েছে একটি শিকারি পাখি। নিচের দিকেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও গভীর মনোযোগ। দেখে মনে হলো, পাইলনের নিচে উড়ে চলা চড়ুই পাখি শিকার করার জন্যই সে তাক করে আছে। ঢাকা নগরীর বিরল বাসিন্দা এ পাখির নাম লালমাথা-শাহিন। পাখিটি ‘ফালকন’ পরিবারের সদস্য এবং ঈগল, বাজ ও শিকড়ে পাখির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নজাতের শিকারি।

বিশ্বে ৫৫ প্রজাতির ফালকন আছে এবং ‘শাহিন’, ‘হবি’, ‘কেস্ত্রেল’, ‘কারাকারা’ ইত্যাদি নামে এরা পরিচিতি পেয়েছে। শেরপুরের শালবনে সম্প্রতি ‘কুটিশাহিন’ পাখির সাক্ষাৎ পাওয়ার পর বাংলাদেশে ফালকন পরিবারে প্রজাতি-সংখ্যা ১০-এ উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র লালমাথা-শাহিনকেই আমরা সারা বছর ঢাকা নগরীতে দেখতে পাই। তবে সহজে নয়, বিশ্বের তাবৎ পাখি-শিকারিদের মতোই সে লুকিয়ে চলতে অত্যন্ত দক্ষ।

অধিকাংশ ফালকনই দ্রুতবেগে উড়ে চলা পাখিদের পাকড়াও করতে পটু। ঢাকাবাসী এই শাহিন পাখিও উড়ন্ত চড়ুই, বাবুই, বুলবুল ও মুনিয়া শিকার করে জীবনধারণ করে। সারা দেশে ছোট পাখির সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও শহরের পথপাশে চড়ুই তো ভালোই আছে। তাই চড়ুই পাখিই হয়েছে লালমাথা-শাহিনের মেইন ডিশ বা খাবার। তবে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় এরা চামচিকা শিকারে নামে; সম্ভবত রুচি বদলাবার জন্য। 

এই পাখি শুধু ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার দক্ষিণে কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এর ইংরেজি নাম ‘রেড-নেকড ফালকন’ এবং প্রমিত বাংলা নাম ‘লালঘাড়-শাহিন’ ছিল। সম্প্রতি দুই এলাকার পাখিকে দুটি পৃথক প্রজাতি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রজাতি ভিন্ন হলে তো নামও ভিন্ন হতে হয়। তাই এখন আফ্রিকার পাখির ইংরেজি নাম ‘রেড-নেকড ফালকন’ আর ভারতবর্ষের ‘রেড-হেডেড ফালকন’ হয়েছে।

চেহারা দেখে এ দুই প্রজাতির পাখির পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। দুটিরই ঘাড় ও মাথা লালচে খয়েরি এবং চঞ্চু, পা-ও চশমা হলদে। ভারতবর্ষের পাখিটির বাংলা নাম ‘লালঘাড়-শাহিন’ বহাল রাখলে আফ্রিকার পাখিটিকে আমরা কী বলব, যদি ভবিষ্যতে কোনো দিন আফ্রিকার পাখির বাংলা নাম দিতে চাই! তাই আমাদের দেশের পাখিটির নাম বদলে ইতোমধ্যে আমরা ‘লালমাথা-শাহিন’ বলতে শুরু করেছি। 

গত শতাব্দীতে বাংলায় লেখা পাখির বইতে কোনো কোনো লেখক এ পাখিকে ‘তুরমতি বাজ’ নাম দিয়েছিলেন। ওই নামের দুটি বড় সমস্যা ছিল। প্রথমত, পাখিটি ‘বাজ’ নয় এবং অন্য একটি পরিবারে অনেক ‘বাজ’ ও ‘তিশাবাজ’ আছে এ দেশে। দ্বিতীয়ত হিন্দি, মারাঠি ও গুজরাটি ভাষায় একে ‘তুরমতি’ অর্থাৎ দ্রুতগামী বলা হয়, বাংলায় নয়। অন্য ভাষা থেকে যদি নিতেই হয়, তো এর সংকেত নাম ‘ভেগি’ই তো ভালো। ভেগি মানেও দ্রুতগামী। 

দেখলাম, পাইলনের প্রায় শীর্ষে লালমাথা-শাহিনের দুটি বাড়ন্ত ছানা বসে রয়েছে। অদূরে বসে আছে আকারে অনেকটা বড় আরেকটি শাহিন। নিশ্চিত বলা যায়, এই বড় পাখিটিই ছানাদের মা। অধিকাংশ শিকারি পাখির মতো এই পাখির মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেকটা বড় হয়। লালমাথা-শাহিনের সংসারে বাবার কাজ হলো পাখি শিকার করে এনে মাকে দেওয়া। আর মায়ের কাজ হলো মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছানাদের খাওয়ানো। ছানারা বাসা ছেড়ে যাওয়ার পরও দু-সপ্তাহ ধরে বাবা-মা এটা করতে থাকে। 

পুরুষ পাখিটি পাইলনের ওপর থেকে এখনো চড়ুই পাখির ওড়াউড়ি দেখছে। মাটির কাছে কিংবা কার্নিশের আড়ালে থাকলে চড়ুই পাখিরা মোটামুটি নিরাপদ। শিকার ধরার জন্য তিরবেগে ছুটে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মরতে চায় না কোনো শাহিন পাখি। কিন্তু চড়ুই পাখিদের জীবনেও নানা চাহিদা, ছোটাছুটি ও কলহবিবাদ আছে। সবাই সব সময় সাবধান থাকে না। পাইলনের ওপর তাই এই শিকারি সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে। 

আমরা চাই, রোদ চড়া হওয়ার আগেই ধৈর্যশীল এই পাখি একটি চড়ুই শিকার করুক। আমাদের এ আকাঙ্ক্ষাটি শাহিন-ছানার জন্য শুভ হলেও চড়ুই পাখির জন্য নির্মম। যে চড়ুই পাখিটি নিহত হবে, তার বাসাতেও হয়তো অভুক্ত ছানা অপেক্ষারত। ওসব নৈতিক সংকট এড়ানোর জন্য তখনই আমরা এলাকাটি ছেড়ে চলে এলাম। 

হালদায় দূষণ, মরছে মা-মাছ

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১০:২৮ এএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১০:২৯ এএম
হালদায় দূষণ, মরছে মা-মাছ
ছবি: খবরের কাগজ

এক সপ্তাহ ধরে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হালদা নদীতে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে মরা মা- মাছ ও ডলফিন। এক সপ্তাহে হালদা নদীতে একটি রুই এবং চারটি কাতলা (এগুলো মা-মাছ, যাকে ব্রুড বলা হয়) এবং একটি ডলফিন মরে ভেসে উঠেছে। এটিকে হালদার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অশনিসংকেত বলে মন্তব্য করেছেন হালদার গবেষকরা।

হালদার দূষণ কী কারণে হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য ৫ সদস্যবিশিষ্ট দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি মৎস্য বিভাগ করেছে, অপরটি পরিবেশ অধিদপ্তরের। 

গত রবিবার (৩০ জুন) দুপুর ১টার দিকে হাটহাজারীর আজিমের ঘাট এলাকা থেকে প্রায় ১৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের (দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৮ সেন্টিমিটার) আরও একটি মৃত কাতলা ব্রুড মাছ উদ্ধার করা হয়।

এর আগে গত ২৫ জুন মঙ্গলবার দুপুরে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা এলাকায় ৯০ কেজি ওজনের ৭ ফুট লম্বা একটি মৃত ডলফিন ভেসে ওঠে। স্থানীয় লোকজন সেটি উদ্ধার করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও বেসরকারি সংস্থা আইডিএফের সহযোগিতায় নদীর পাড়ে হ্যাচারি এলাকায় মাটিচাপা দেয়।

২৮ জুন হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী এলাকা থেকে দুটি কাতলা ব্রুড মাছ উদ্ধার করা হয়। একটির ওজন ছিল ১০ কেজি এবং দৈর্ঘ্য ৫৮ সেন্টিমিটার, অপরটির ওজন ১২ কেজি ৫০০ গ্রাম দৈর্ঘ্য ৯৮ সেন্টিমিটার। 

গত ২৬ জুন রাউজান উরকিরচর বাকর আলী চৌধুরী ঘাট এলাকায় ১০ কেজি ওজনের একটি রুই মা-মাছ মরে ভেসে ওঠে। তার কয়েক দিন আগেও ১২ কেজি ওজনের একটি কাতলা মা-মাছ মরে ভেসে উঠেছিল।

হালদা নদীতে গত দুই বছর পরে কয়েকদিনের মধ্যে পাঁচটি ব্রুড মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু হালদার পরিবেশের জন্য একটি অস্বাভাবিক ঘটনা বলে জানিয়েছেন হালদার গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. মনজুরুল কিবরিয়া। 

তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেশ কয়েক মাস ধরে শাখা খালসমূহে দূষণের খবর বেশ কিছু সংবাদপত্র গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে আসছে। এই ব্রুড মাছের মৃত্যুর জন্য প্রাথমিকভাবে শাখা খালসমূহের দূষণ এবং বিষ প্রয়োগে মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করি। হালদা নদী তথা বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ রক্ষার জন্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কারণ উদঘাটন করে রিপোর্ট দেওয়ার পর হালদা দূষণ এবং মা-মাছের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’ 

তিনি আরও বলেন, একটি হতাশাজনক বিষয় হলো ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এ বছর সবচেয়ে কম পরিমাণ ডিম দিয়েছে। যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি। ইতোমধ্যে প্রজনন মৌসুমের ৬টি জো শেষ হওয়ার মাধ্যমে ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেছে। জুলাই মাসে মাছ ডিম ছাড়ার কোনো রেকর্ড নাই। হালদার ডিম সংগ্রহকারীদের এত হতাশার মধ্যে পাঁচটি ব্রুড মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু হালদা নদীর পরিবেশগত বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে। 

সূত্র মতে, পাঁচ বছরে হালদায় ৪৩টি ডলফিন ও ৩০টি রুই ও কাতলা মা-মাছের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু সপ্তাহের ব্যবধানে ছয়টি মাছের মৃত্যু এবারই প্রথম। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মা-মাছের মৃত্যুর ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। 

তিনি জানান, মরা মা-মাছের নমুনা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে আরও অধিকতর পরীক্ষার জন্য মরা মা-মাছের নমুনার ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। 

যেসব খালের কারণে দূষিত হচ্ছে হালদা: 
চট্টগ্রাম নগরের খন্দকিয়া খাল, কাটাখালি খাল ও কৃষ্ণখালি খাল দিয়ে শহরের দূষিত ও ময়লা পানি এবং বর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। মদুনা ঘাটের নিচের দিকে কাটাখালি ও কৃষ্ণখালি খাল হালদায় পড়েছে। এই দুটি খাল দিয়ে কালুরঘাট শিল্প এলাকার বাইরের সিগন্যাল এলাকা দিয়ে শিল্প কারখানার দূষিত পানি সরাসরি হালদায় গিয়ে পড়ছে। অপরদিকে খন্দকিয়া খাল দিয়ে শহরের বর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। মূলত এ তিন খাল দিয়ে আসা দূষিত পানির কারণে হালদার মা-মাছ মরছে। 

ভূজপুর রাবার ড্যামের প্রভাব: 
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানা এলাকায় হালদা নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ ও চা বাগানের পানি ব্যবস্থার জন্য হালদার রাবার ড্যামটি ফুলিয়ে পানি বন্ধ রাখা হয়। এতে হালদায় মিঠা পানির সংকট সৃষ্টি হয়। পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আবার মা-মাছ ডিম ছাড়ার সময় রাবার ড্যামটি ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা বর্জ্য, চাষাবাদের দূষিত পানি, চা বাগানের বর্জ্য এসে মা-মাছের অভয়ারণ্য এলাকায় মিশে যায়। এসব কারণে মা-মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। 

চট্টগ্রাম জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের রিসার্চ অফিসার মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে হালদা ও কর্ণফুলীর দূষণের উৎস খোঁজার জন্য। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের একটি টিম সোমবারও হালদায় গিয়েছে পানির প্যারামিটার পরীক্ষা করার জন্য। তবে সব দিক থেকে চেষ্টা করা গেলে হালদার প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করা যাবে। 

দেশে প্রাণীটির বিলুপ্তির শঙ্কা ছয়বার ডিম দিয়েও বাচ্চা ফোটাতে পারেনি ঘড়িয়াল

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪, ০৯:০৮ এএম
আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪, ০৯:০৯ এএম
ছয়বার ডিম দিয়েও বাচ্চা ফোটাতে পারেনি ঘড়িয়াল
রাজশাহীর শহিদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেনে থাকা ঘড়িয়াল জুটি। ইনসেটে ঘড়িয়ালের ডিম

রাজশাহীর শহিদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেনে থাকা স্ত্রী ঘড়িয়ালটি আবারও ডিম দিয়েছে। তবে এর আগে ছয়বার ডিম দিলেও বাচ্চা ফোটানো যায়নি। এবার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ঘড়িয়ালের প্রজনন উপযোগী পরিবেশও তৈরি করা হয়। প্রজনন করানো না গেলে দেশে প্রাণীটির বিলুপ্তির শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এর আগে ১৯৯০ সালে পদ্মা নদী থেকে দুটি স্ত্রী ঘড়িয়াল উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেনে রাখা হয়। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো উদ্যোগ নেওয়া হয় তাদের বংশ বৃদ্ধি ঘটানোর। তখন একটি স্ত্রী ঘড়িয়াল ঢাকায় স্থানান্তর করে সেখান থেকে একটি পুরুষ ঘড়িয়াল আনা হয়। প্রত্যাশা অনুযায়ী নারী ঘড়িয়ালটি ডিম দিলেও কোনোভাবেই তা থেকে বাচ্চা ফোটানো যায়নি। 

উদ্যানে কর্মরত বারব আলী জানান, ৬ দফায় ডিম দিলেও সেগুলো কোনোভাবেই প্রজননের জন্য বাচ্চা ফোটানো যায়নি। বেশির ভাগ ডিম পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে অন্তত ৩২টি ডিম দেয়। তবে পানিতে দেওয়ায় তা নষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। এর আগেও একইভাবে ঘড়িয়ালের ডিম নষ্ট হয়েছে। তবে গত বছর অল্প কিছু ডিম পুকুরের পাড়ে পাওয়া যায়। সেগুলো বালুতে পুঁতে রাখলেও ফল মেলেনি। অনেক ক্ষেত্রে ঘড়িয়াল নিজেই ডিমগুলো নষ্ট করে দেয়। 

প্রায় তিন মাস আগে ঘড়িয়ালের প্রজননের বিষয়ে কাজ করতে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছেন সরীসৃপ গবেষক বোরহান বিশ্বাস রমন। তিনি বলেন, ‘ডিম ফোটানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অভাব এখানে প্রধান সমস্যা। প্রজনন মৌসুমে ডিম দেওয়ার অন্তত তিন মাস আগে থেকেই ঘড়িয়াল পলিমিশ্রিত মাটি, নরম ঘাস রয়েছে এমন স্থান নির্বাচন করে রাখে। যেখানে দিনে তাপ থাকবে, রাতেও তাপ ধরে রাখবে। কিন্তু এখানে সেই পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে না।’

বোরহান বিশ্বাস রমনের পরামর্শে সম্প্রতি উদ্যানে পুকুরের এক পাশের মাটি ও ঘাস বলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রজনন মৌসুমে ঘড়িয়ালগুলোকে দর্শনার্থী থেকে আড়ালে রাখারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
 
বোরহান বিশ্বাস রমন বলেন, ‘প্রজননে সফল হলে নদীতে ঘড়িয়াল বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। তবে তার আগে নিরাপদ ও দূষণমুক্ত নদী নিশ্চিত করতে হবে। এখান থেকে দুটি ঘড়িয়ালের বাচ্চা উৎপাদন করা গেলেও আগামী ৫০ বছর প্রাণীটি দেশে টিকে থাকবে। কেননা, ঘড়িয়ালের গড় আয়ু অন্তত ৬০ বছর। এরা সর্বাধিক ২০ ফুট লম্বা এবং ১৬০ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। মার্চ ও এপ্রিল ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু।

এ সময়ে মা ঘড়িয়াল নদীর বালিয়াড়িতে ডিম পেড়ে বালু দিয়ে ঢেকে রাখে। একসঙ্গে এরা ২০ থেকে ৯৫টি ডিম পাড়ে। ৭১ থেকে ৯৩ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির আগে পদ্মা নদীতে মিঠা পানির ঘড়িয়ালের দেখা মিলত। পরে নদীতে রুক্ষতা দেখা দেওয়ায় ক্রমেই বিলুপ্ত হয় প্রাণীটি। এখন বলতে গেলে দেশের প্রকৃতিতে ঘড়িয়াল দেখাই যায় না।’