![পরমসুন্দর উদয়পদ্ম ফুল](uploads/2024/05/10/flower-1715313400.jpg)
পদ্মের মতো যে ফুলের উদয়, নাম তো তার উদয়পদ্মই হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ফুলপ্রেমীর কাছে সে এ নামের চেয়ে ম্যাগনোলিয়া নামেই বেশি পরিচিত। উদয়পদ্ম নামটি দিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উদয়পদ্ম দেখতে পদ্মের মতো হলেও পদ্ম না। ডালের ঠিক আগায় সূর্যের মতো উদয় হয় বলে কবিগুরু এর নাম দিয়েছিলেন উদয়পদ্ম।
বৈশাখের এক সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের প্রাঙ্গণে একজোড়া ম্যাগনোলিয়া গাছের সব ডালে ফোটা ফুল দেখে মন ভরে গেল। কাছে যেতেই ফুলগুলোর সুমিষ্ট সুবাস বাতাসে ভেসে এল। আহ্, কি মধুর ঘ্রাণ! কিন্তু বিপত্তি বাধল যখন ফুলের ছবি তুলতে চাইলাম। প্রায় ২০ ফুট উঁচু গাছে ডালের আগায় ফুলের উদয়। এ গাছ আরও লম্বা হতে পারে, ৭০-৮০ ফুট লম্বা গাছও এ দেশের পাহাড়ি অরণ্যে আছে। একটি বয়স্ক গাছ কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম রংপুরের পায়রাবন্দে, বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে।
কার্জন হলের সামনের গাছ দুটির প্রায় সব ডালের আগায় ফুল ফুটে রয়েছে। একটি ডালকে যখন বাগে আনা গেল, তখন পূর্ণ প্রস্ফুটিত রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম। গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানেও দেখেছিলাম কয়েকটি ম্যাগনোলিয়া গাছ। কিন্তু সেসব গাছে ফোটা ফুলগুলোর চেয়ে এ দুটি গাছের ফুল অনেক বড়। প্রাণবন্ত, সতেজ ও লাবণ্যময়ী। ফুলের ছবি তোলার পর শুরু করলাম সেই লাবণ্যময়ী উদয়পদ্মের অবয়ব পাঠ।
পাপড়ির বিস্তার পাওয়া গেল প্রায় ৭ ইঞ্চি। ১০টি পাপড়ি ২টি সারিতে সাজানো। প্রথম বা ওপরের সারির পাপড়িগুলো ছোট, পরের সারিরগুলো বড়। জ্বাল দেয়া দুধের মতো পাপড়ির রং। কোনো কোনোটার রং আবার বরফসাদা। এ জন্য এ ফুলের আরেক নাম হিমচাঁপা, হিন্দিতেও এর নাম হিমচাঁপা।
ম্যাগনোলিয়া ছোট বৃক্ষ প্রকৃতির। বহুবর্ষজীবী ও চিরসবুজ। পাতা দেখতে কিছুটা কাঁঠালপাতার মতো। তবে কাঁঠালপাতার চেয়ে ম্যাগনোলিয়া গাছের পাতা লম্বাটে ও ছোট। পাতার ওপরের পিঠ চকচকে কালচে সবুজ বা তামাটে, নিচের পিঠ মখমলের মতো ও বাদামি। পাতার আকৃতি লম্বাটে উপবৃত্তাকার ও পত্রফলকের আগা কিছুটা ভোঁতা, ফলকের কিনারা সামান্য নিচের দিকে বাঁকানো। পাতাগুলো ডালের ওপর ঊর্ধ্বমুখীভাবে সাজানো থাকে। ফুল ফোটা শুরু হয় বসন্তের শেষ থেকে, ফুটতে থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। তবে গ্রীষ্মকালে বেশি ফুল ফোটে।
ম্যাগনোলিয়া ফুলের কেন্দ্রস্থলে থাকে একটি প্যাগোডা বা শম্বুকের মতো জননাঙ্গ, কি চমৎকার তার গড়ন! কদিন পর ওই অঙ্গটাই বড় হতে হতে ফল হয়। আকার বদলায়। কিন্তু তার আকৃতি বদলায় না। পাপড়িঝরা সেসব ফল থাকে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে। একপলকে ফুলকে দেখলে ওকে শ্বেতপদ্মের মতোই মনে হবে। ফুলগুলোও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাপড়িগুলো সম্পূর্ণ খোলে না।
উদয়পদ্মের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা, গোত্র ম্যাগনোলিয়েসী। ইংরেজি নাম লরেল ম্যাগনোলিয়া। উদয়পদ্মের আদি নিবাস যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও টেক্সাসে। এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ম্যাগনোলিয়া গাছ আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের মতো পৃথিবীর আর কোনো দেশে একে এত বেশি সহজে চোখে পড়ে না। সেখানে প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও রাস্তার ধারে ম্যাগনোলিয়া গাছ লাগানো আছে। আর থাকবেই বা না কেন? ম্যাগনোলিয়া যে সে অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ফুল। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২-এর তফসিল ৪ অনুসারে ম্যাগনোলিয়া এ দেশে সংরক্ষিত উদ্ভিদ, যেখানে যেটা আছে সে গাছ কাটা বারণ। কার্জন হলের সামনে ছাড়াও এ গাছ আছে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে, বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশে, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় হোটেল ইম্পিরিয়ালে বসে তার ‘বনবাণী’র ভূমিকা লিখেছিলেন। সেখানেই তাকে আন্দোলিত করেছিল গাছগাছালির পরমসুন্দরতা। তিনি লিখেছিলেন, ‘পরমসুন্দরের মুক্তরূপে প্রকাশের মধ্যেই পরিত্রাণ, আনন্দময় সুগভীর বৈরাগ্যই হচ্ছে সেই সুন্দরের চরম দান।’ উদয়পদ্ম ফুলগুলোর সান্নিধ্যে সকালটা কাটিয়ে মনে হলো, আমি সেই পরমসুন্দরের দেখা পেয়েছি, আহ্বানও শুনেছি এক বৈরাগ্যের। পরমসুন্দর- সে তো ম্যাগনোলিয়ার মাত্র এক বেলার জন্য সুন্দরী যুবতী থাকার অহংকার, বৈরাগ্য- সে হলো সেই পরমসুন্দরের খসে পড়া, শিথিল কটিবাসের মতো একটার পর একটা খসে পড়ে পাপড়িগুলো গাছের তলায়।
তা দেখেই হয়তো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন: ‘ম্যাগনোলিয়ার শিথিল পাপড়ি থরে থরে/ পড়ে ঘাসে।’ উদ্যানে উদ্যানে ম্যাগনোলিয়া গাছ চোখে পড়লেও তা খুব সুলভ নয়, আরও বেশি এ গাছ লাগানো যায়। গ্রীষ্মকালে এ গাছের আধা কাষ্ঠল শাখা কেটে কলম করে চারা তৈরি করা যায়।