![দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের ২ ধাপ অবনতি : টিআই](uploads/2024/01/30/1706603778.TI.jpg)
বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান দশম, যা গতবার ছিল দ্বাদশ। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এটি গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সূচকে সবচেয়ে কম ১১ স্কোর পেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া। জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০২৩ সালের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বার্লিনের সঙ্গে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
সিপিআই সূচকে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে শূন্য থেকে সর্বোচ্চ ১০০-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। দুর্নীতির ক্ষেত্রে শূন্য স্কোরকে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। টিআই কর্তৃক ২০১২ থেকে ২০২৩ মেয়াদের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের এবারের স্কোর সার্বিক ১২ বছরের গড় স্কোর ২৬-এর তুলনায় দুই পয়েন্ট কম এবং এই মেয়াদে সর্বনিম্ন। তালিকায় সর্বোচ্চ ১০০ স্কোরের মধ্যে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৯তম, স্কোর ২৪। অথচ গত বছর ছিল ১৪৭তম, স্কোর ছিল ২৫। অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ২ পয়েন্ট অবনতি হয়েছে। সমানসংখ্যক স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকান রিপাবলিক, ইরান, লেবানন ও জিম্বাবুয়ে।
বাংলাদেশের নিম্ন অবস্থানের ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলা হয়, গত কয়েক বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’র সবচেয়ে আলোচিত মেয়াদ ছিল। কিন্তু এই মেয়াদে এই ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কৌশলনির্ভর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু এই মেয়াদে দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়কালে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং এর জন্য যারা দায়ী, তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কার্যকর দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকরতা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতার অবস্থানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপকতা বেড়ে স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ব্যাপকতর হয়েছে।
টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে আফগানিস্তান, তৃতীয় পাকিস্তান, চতুর্থ শ্রীলঙ্কা, পঞ্চম নেপাল, ষষ্ঠ ভারত ও মালদ্বীপ এবং সপ্তমে ভুটান।
১৩ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা। ১৬ স্কোর নিয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে ইয়েমেন। ১৭ স্কোর নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে গিনি, হাইতি, উত্তর কোরিয়া ও নিকারাগুয়া। পঞ্চম স্থানে ১৮ স্কোর নিয়ে লিবিয়া ও তুর্কমেনিস্তান। ষষ্ঠ স্থানে আফগানিস্তানসহ সাতটি দেশ। সপ্তম স্থানে আফ্রিকার অন্তরীপের দেশ ইরিত্রিয়া, অষ্টম স্থানে কম্বোডিয়াসহ তিনটি দেশ, নবম স্থানে রয়েছে আজারবাইজানসহ চারটি দেশ।
সূচকে কম দুর্নীতির শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে এক নম্বরে রয়েছে ডেনমার্ক। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফিনল্যান্ড, তৃতীয় নিউজিল্যান্ড, চতুর্থ নরওয়ে, পঞ্চম সিঙ্গাপুর, ষষ্ঠ সুইডেন, সপ্তম সুইজারল্যান্ড, অষ্টম নেদারল্যান্ডস, নবম লুক্সেমবার্গ দশম জার্মানি।
প্রতিবেদন অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির হার বেশি। সিপিআইয়ে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টির মধ্যে ১০৫টি দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর কম স্কোর করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই গড় স্কোর ৪৩-এর চেয়ে কম পেয়ে সূচকের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী অতীব উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে বাস করছে। আর সূচকে অন্তর্ভুক্ত দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি- ১২২টি দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে, যার অর্থ এসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক।
সূচকে দুর্নীতির ১০টি ধরন ও বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ঘুষ ও সরকারি তহবিল তছরুপ, সরকারি চাকরির নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত লাভের জন্য কর্মকর্তাদের সরকারি অফিসের অবাধ ব্যবহার, সরকারি কর্মকর্তাদের আর্থিক এবং সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকাশের আইনি বাধ্যবাধকতা, সরকারি কাজে অতিরিক্ত লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, যা দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলয়ে কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দখলদারত্ব, দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলার কার্যকর বিচার, সরকারি খাতে দুর্নীতি দমনে সক্ষমতা, ঘুষ ও দুর্নীতির ঘটনার তথ্য প্রকাশকারীদের আইনি সুরক্ষা এবং জনসংশ্লিষ্ট কিংবা সরকারি কর্মকাণ্ডে তথ্যের অভিগম্যতা।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিপিআই (দুর্নীতির ধারণা সূচক) অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। সূচকের বিশ্লেষণ করলে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন। স্কোর ও অবস্থানের এই অবনমন প্রমাণ করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা বাস্তবিক অর্থে কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরও অবনতি হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান ও স্কোর যথারীতি বিব্রতকরভাবে আফগানিস্তানের পর।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের চলমান কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তারপরও এ দেশের নবগঠিত সরকার পুনরায় দুর্নীতি প্রতিরোধে যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, তাদের সেই অঙ্গীকার সম্পর্কে আমরা আশাবাদী হতে চাই।’
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, নির্বাচনের আগে সব সরকারই দুর্নীতি প্রতিরোধে ইতিবাচক অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না, যা খুবই নেতিবাচক। তাই সরকারের অঙ্গীকারে সততা ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সরকারি নীতিনির্ধারক ও কর্তাব্যক্তিদের প্রতিরক্ষামূলক বক্তব্যে দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলে মনে করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম, সমন্বয়ক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
১৯৯৫ সাল থেকে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা প্রতিবছর এই সূচক প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রথম তালিকাভুক্ত হয়। তখন এ তালিকায় মোট ৯১টি দেশ ছিল।
এলিস/অমিয়/এমএ/