বাজারে কমে গেছে তরমুজের দাম। তারপরও দেখা মিলছে না ক্রেতার। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে ক্রেতা না পেয়ে পচে যাচ্ছে তরমুজ। পচে যাওয়া তরমুজ ফেলে দিতে হচ্ছে নদী-নালা, খাল, সড়ক ও ময়লার ভাগাড়ে। অথচ রমজানের শুরুতে অনেক লাভ হলেও এখন তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। লাভের আশায় থেকে এখন তরমুজ ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে লোকসান।
তরমুজের বড় আড়ত রাজধানী ঢাকার বাদামতলী। এই আড়তের আশপাশের সড়কে, ডাস্টবিনে, নদী-নালায় পড়ে থাকতে দেখা যায় বিপুল পরিমাণ পচা তরমুজ। এমন চিত্র দেশের সবখানেই। এ পরিস্থিতিতে লোকসানের আতঙ্কে অনেক পাইকার তরমুজ কেনাবেচা বন্ধ করে দিয়েছেন। শুরুতে কৃষকরা ভালো দাম পেলেও এখন উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। এখন পাইকাররা তরমুজ কেনা বন্ধ করায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
প্রতিদিন ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে নৌপথে ঢাকার বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাটে ট্রলার ও ছোট-বড় বিভিন্ন নৌকায় তরমুজ নিয়ে আসেন পাইকাররা। এই ঘাটের পাড়ে ও পানিতে ফেলে দেওয়া পচা তরমুজের কারণে ট্রলার ও নৌকা ঠিকমতো ভিড়তে পারে না।
চট্টগ্রামে ময়লার ভাগাড়ে তরমুজ
চট্টগ্রামে তরমুজের দাম পাইকারিতে কমলেও বিক্রি হচ্ছে না। ফলে অনেক ব্যবসায়ী পচে যাওয়া তরমুজকে ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিতে বাধ্য হন। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে অর্ধেকে নেমে এসেছে তরমুজের দাম। এক সপ্তাহ আগে বড় সাইজের তরমুজ পাইকারিতে আড়াই শ টাকা বিক্রি হতো, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। আর মাঝারি সাইজের যেটি আগে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হতো, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে আশি থেকে ১০০ টাকায়। ছোট সাইজের তরমুজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই।
চট্টগ্রামের ফলমন্ডির ব্যবসায়ীরা জানান, বৃষ্টি হলেই তরমুজ নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টির পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরমুজ ফেটে যায়। আবার খেতে থাকা তরমুজে শিলাবৃষ্টি হলে সব নষ্ট হয়ে যায়। ফলে খামারিরা তরমুজ আগাম তুলে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। রোজা উপলক্ষে তরমুজের অধিকতর চাহিদা তো আছেই। ফলে খেত খামারিরা যে হারে তরমুজ বাজারে বিক্রি করছেন সেই হারে বাজার থেকে তরমুজ খুচরায় বিক্রি হচ্ছে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে না পারায় আড়তেই পড়ে থাকছে তরমুজের স্তূপ। দীর্ঘদিন আড়তে থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব তরমুজ। পুরোপুরি পচে যাওয়া তরমুজ ফেলে দিতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নদী-নালা ও ময়লার ভাগাড়কেই বেছে নিতে হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় রাস্তার পাশে ফেলা তরমুজ খাচ্ছে মহিষ এমন দৃশ্য দেখা যায়। আশপাশে পথচারীরা মন্তব্য করেন, সাধারণ ক্রেতারা বয়কট করায় তরমুজ মহিষকে খাওয়াতে হচ্ছে। এটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বড় প্রতিবাদ হয়েছে।
চট্টগ্রামের ফলমন্ডির তরমুজ ব্যবসায়ী ‘বিসমিল্লাহ ফল ভাণ্ডারের’ মালিক মনির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, একসপ্তাহে আগে ১০০ পিস তরমুজ ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা বিক্রি হতো পাইকারিতে। এখন সেগুলো বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। তরমুজের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এরপরও আগের মতো বিক্রি নেই।
‘মেসার্স শাহাব উদ্দিন ফল বিতানের’ মালিক মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, আড়তেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তরমুজ। কারণ অনেক বেশি পরিমাণে তরমুজ আড়তে আসছে প্রতিদিন। কিন্তু সেই হারে বিক্রি হচ্ছে না। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তারমুজ।
‘ফাতেমা ট্রেডার্সের’ মালিক মো. শাহীন আলম খান বলেন, আড়তে পর্যাপ্ত তরমুজ আছে। বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। সপ্তাহ খানেক আগেও যে পরিমাণ তরমুজ বিক্রি হতো এখন সে হিসেবে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে না। আড়তে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে তরমুজ। ফলে ফেলে দিতে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ফলমণ্ডির ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, বাজারে তরমুজের চাহিদা কমে গেছে। অপর দিকে প্রচুর তরমুজ আড়তে আসছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে তরমুজ।
বরিশালের কীর্তন খোলা খালে পচা তরমুজ
গতকাল দেখা গেছে, তরমুজ বোঝাই ট্রলারগুলো আড়তসংলগ্ন কীর্তন খোলা নদীর শাখা খালে নোঙর করে আছে। কোনোটির পণ্য নামানো হচ্ছে। কোনোটিতে চাষি আর আড়তদারের মধ্যে দর-কষাকষি চলছে। কোনো কোনো নৌকা ও ট্রলারের থাকা পচে যাওয়া তরমুজ খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে। খালে পানিতে পচে যাওয়া তরমুজের গন্ধ পুরো পোর্ট রোড এলাকায় ছড়িয়ে পরছে। এতে করে খালের পানিসহ এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বরিশালের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আকার ও মান ভেদে প্রতি পিচ তরমুজ পাইকারি বাজারে ২৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ১৫ দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ১০০ টাকার উপরে। হঠাৎ করে দাম কমার কারণে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ভোলার তরমুজ চাষি মাসুদ মিয়া বলেন, চলতি মৌসুমের প্রথম দিকে তরমুজের দাম ভালোই পেয়ে ছিলাম। কিন্তু মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তরমুজ বিক্রি করতে হচ্ছে পানির দামে।
চাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এ বছর তরমুজের রেকর্ড ফলন হয়েছে। কিন্তু বাজারে মূল্য পাচ্ছি না। এতে লোকসান গুনতে হবে।’
বরিশাল পাইকারি ফল বিক্রি আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গণেশ দত্ত বলেন, বর্তমানের তরমুজের দাম পানির দরে বিক্রি না হলেও কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত দামে তরমুজ বিক্রি করতে পারছে না। কারণ, এ বছর বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ অনেক বেশি।