![ঈমানের দুর্বলতা দূর করার ১০ উপায়](uploads/2023/12/03/1701577517.eman.gif)
পূর্ণাঙ্গ ঈমান মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। পরিচর্যার অভাবে ঈমান দুর্বল হয়; সঠিক পরিচর্যায় ঈমানের দুর্বলতা দূর হয়, ঈমান সতেজ এবং সজীব হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের অন্তঃকরণের ঈমান জরাজীর্ণ হয়; যেমন জরাজীর্ণ হয় পুরোনো কাপড়। আল্লাহর কাছে দোয়া করো, তিনি যেন তোমাদের অন্তঃকরণের ঈমানকে নতুন করে দেন।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪)
চলুন, ঈমানের দুর্বলতা দূর করার উপায়গুলো জেনে নিই—
১. বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত এবং দ্বীনি চিন্তা-গবেষণায় সময় ব্যয় করা: ঈমান বৃদ্ধি করার অন্যতম উপায় হলো, বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত। এতে ঈমানের দুর্বলতা দূর হয়, নতুনভাবে ঈমানি শক্তি বলিয়ান হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, তারাই মুমিন। আর তাদের সামনে আয়াতসমূহ পাঠ করা হলে তা তাদের ঈমানে বৃদ্ধি ঘটায় এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে (তারাই মুমিন)।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২)
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কোরআনে এমন বিষয় নাজিল করি; যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৮২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন, কোরআনের বিধান ও বর্ণনা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতেন এবং কোরআন দ্বারা প্রভাবিত হতেন। (ঈমানের দুর্বলতা, শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, অনুবাদ: হাসান মাসরুর, রুহামা পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা: ৪৩)
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) পবিত্র কোরআন দ্বারা ঈমানি দুর্বলতা দূরীকরণের দুটি পদ্ধতির কথা বলেছেন, (ক.) পবিত্র কোরআনের বর্ণনার আলোকে আপনার অন্তরকে দুনিয়া থেকে আখেরাতমুখী করুন; ঈমানি দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে।
(খ.) পবিত্র কোরআনের অর্থ বুঝুন, আয়াত নাজিলের কারণ বোঝার চেষ্টা করুন, প্রত্যেক আয়াত থেকে নিজের প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং তা অন্তরের ব্যাধি ও ঈমানি দুর্বলতা রোধে প্রয়োগ করুন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৪৬)
২. সব সময় আল্লাহর জিকির, তাঁর বড়ত্ব, নাম, গুণাবলি ও সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, তাঁর নিদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাকওয়া অর্জন এবং একান্তভাবে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা বা তাঁকে ডাকা: আল্লাহতায়ালার স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত রাখা, তাঁর নাম, গুণাবলি ও সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং একান্তভাবে তাঁর কাছে প্রার্থনা করার দ্বারা ঈমানি দুর্বলতা দূর করা সম্ভব। আল্লাহতায়লা বলেন, ‘জেনে রাখো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর জিকির বা স্মরণেই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’ (সুরা রদ, আয়াত: ২৭)
আরেক আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আর যে আল্লাহতায়লার নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তা তার অন্তরের তাকওয়া থেকেই হয়।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩২)
আল্লাহকে ভালোবাসা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর প্রতি সুধারণা রাখা এবং ভরসা করা, তাঁর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং তওবা করায় মুমিন-মুসলমানের তাকওয়া অর্জন হয়। এসব কাজের দ্বারা ঈমানি দুর্বলতা দূর হয়। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ৭৬)
একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমেও ঈমানি দুর্বলতা দূর হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা সিজদারত অবস্থায় তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। সুতরাং তোমরা বেশি বেশি দোয়া করো।’ (মুসলিম, হাদিস: ৪৮২)
৩. ইসলামি জ্ঞানার্জন ও আমল করা এবং দ্বীনি সভায় অংশগ্রহণ করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের ওপর দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা করা ফরজ।’ (বুখারি, হাদিস: ২৮)
ইসলামি জ্ঞান চর্চা এবং আমলের দ্বারা ঈমানি দুর্বলতা দূর হয়। এ জ্ঞান অন্তরে আল্লাহভীতি ও প্রীতি সৃষ্টি করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই শুধু আল্লাহকে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির, আয়াত: ২৮)
ঈমানের দুর্বলতা রোধ বা ঈমানি শক্তিকে বৃদ্ধি করার অন্যতম উপায় হলো জ্ঞান। তবে অবশ্যই সে জ্ঞান হতে হবে দ্বীনি বা উপকারী জ্ঞান অথবা যে জ্ঞান মানুষকে আখেরাতমুখী করে। (ইমানবৃক্ষ, ড. ইয়াসির কাদি, অনুবাদ: মুহাম্মাদ খালিদ সাইফুল্লাহ, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা: ১৭১)
দ্বীনি সভায় অংশগ্রহণ করার দ্বারা ঈমান তাজা হয়। মুয়াজ (রা.) এক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ‘আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসো! এসো দ্বীনি আলোচনা করে আমরা আমাদের ঈমানকে তাজা ও বৃদ্ধি করি।’ (আরবাউ মাসাইল ফিল ঈমান, পৃষ্ঠা: ৭২)
৪. নিজেকে বিভিন্ন আমল-ইবাদতে মশগুল রাখা এবং বেশি বেশি নেক কাজ করা: ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ইবাদত পালনের পাশাপাশি নিজেকে বেশি বেশি নফল আমলে মশগুল রাখার দ্বারা ঈমানি দুর্বলতা দূর করা সম্ভব। শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক বিভিন্ন আমল-ইবাদতে নিজেকে জড়িত রাখার চেষ্টা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জিন ও মানুষকে শুধু আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৬)
সময়কে যত বেশি সম্ভব নেকির কাজে, ভালো আমলে ব্যয় করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে ঈমানি দুর্বলতা দূর করা সম্ভব।
৫. পরকালে বিশ্বাস রেখে পরকালীন বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা করা এবং মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা: পরকালের ওপর বিশ্বাস রেখে পরকালীন বিষয়াদি নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা-গবেষণা করলে ঈমানি দুর্বলতা দূর হয়। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন বর্ণনায় এবং অসংখ্য হাদিসে পরকালের অবস্থা নিয়ে যত আলোচনা এসেছে, তার প্রতি বিশ্বাস রেখে সেগুলো নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা-গবেষণা করলে ঈমানি দুর্বলতা দূর হয়ে ঈমান শক্তিশালী হবে। (ঈমানের দুর্বলতা, শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, অনুবাদ: হাসান মাসরুর, রুহামা পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা : ৬৮-৬৯)
মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে গুনাহ থেকে বিরত থাকার স্পৃহা তৈরি করে। অন্তর নরম করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বরেছেন, ‘তোমরা (দুনিয়ার) স্বাদ-আহ্লাদ নিঃশেষকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৬)
এ ছাড়া ৬. খারাপ বা অশুভ পরিণতির আশঙ্কা করা। ৭. দুনিয়ার মোহ ত্যাগের নিয়তে অতিরিক্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করা। ৮. দুনিয়াকে প্রধান্য না দেওয়া। ৯. বিনয়ী হওয়া এবং সহজ ও সাদাসিদে চলাফেরা করা এবং ১০. মুমিনের সাহচর্য গ্রহণ করা এবং কাফের-মুশরিকের সংস্পর্শ ত্যাগ করার দ্বারা ঈমানের দুর্বলতা দূর হয়। ঈমান শক্তিশালী হয়।
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক