![চার মাসে রাজস্ব ঘাটতি ১৪ হাজার কোটি টাকা](uploads/2023/11/17/1700198770.NBR.jpg)
রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বাড়ছেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে যে পরিমাণ ঘাটতি ছিল চার মাসে অর্থাৎ অক্টোবরে ঘাটতি আরও বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলেছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বৈশ্বিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতির যে দুরবস্থা, তাতে চলতি অর্থবছরে প্রথম চার মাসে রাজস্ব আহরণে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তাকে খুব একটা খারাপ বলা যায় না।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, রাজস্ব আহরণের দিক থেকে এনবিআর প্রথাগতভাবে সব সময়ই পিছিয়ে আছে। এটা নতুন কিছু নয়। তবে এ বছরের শুরুতে ঘাটতি যেভাবে বাড়ছে, তা উদ্বেগের বিষয়। কারণ নির্বাচনের বছর সরকারি ব্যয় বাড়ে। আয় যদি ভালো না থাকে, তা হলে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। তাদের মতে, এমনিতেই অর্থনীতির অবস্থা নড়বড়ে। তার ওপর সরকারের ঋণ গ্রহণ এই সময় বেড়ে গেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রথম চার মাসের রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আদায় করেছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৯৪ টাকা। তার মানে আলোচ্য অর্থবছরের চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে আছে বা ঘাটতি হয়েছে ১৩ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। এই চার মাসে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে বা প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪ শতাংশের বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থনীতির সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিকে অবশ্যই ভালো বলতে হবে। হরতাল-অবরোধের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। আর অর্থনীতি গতিহীন হলে রাজস্ব আহরণে বিরূপ প্রভাব পড়ে। আমরা চেষ্টা করছি আদায় বাড়াতে।’ এ জন্য নিবিড় তদারকিসহ অনেক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
অর্থনীতির সঙ্গে রাজস্ব আহরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ১ শতাংশ বাড়লে রাজস্ব বাড়ে ৪ শতাংশ হারে। এ জন্য অর্থনীতির দুরবস্থা হলে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৪ শতাংশ আদায় হয়। বাকি ৭৬ শতাংশ আদায় করতে হবে পরবর্তী আট মাসে।
সূত্র বলেছে, সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে বা প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৩০ শতাংশের বেশি, যা কখনোই সম্ভব নয়।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, দেশের জিডিপির যে আকার তাতে রাজস্ব আদায় হওয়া দরকার বছরে কমপক্ষে ৫ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু এনবিআর যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে থাকে, তাতে কমপক্ষে ২ লাখ কোটি টাকা কম আদায় হয়। অর্থাৎ আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক- এই তিন খাতে বছরে ২ কোটি টাকা ফাঁকি হয়। এই টাকার বড় একটি অংশ আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে মত দেন তিনি।
রাজস্ব বোর্ডের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ আদায় হয়েছে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক খাতে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। আর ঘাটতি ৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি শুল্ক বেড়েছে বা প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ।
আমদানিতে এলসি বা ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে শুল্ক আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ডলারসংকট না কাটা পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকবে। আবার ডলার পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। এ খাতেও আদায় আশানারূপ নয়। জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যেখানে গত বছরে একই সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। ভ্যাট কর্মকর্তরা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা থাকলে ভ্যাট আদায় বাড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে ভ্যাট আহরণে প্রভাব পড়েছে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের অন্যতম আরেকটি খাত হচ্ছে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর। যা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান সরাসরি দিয়ে থাকে। রাজস্ব বোর্ডের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আয়কর আদায় বেড়েছে বা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ সময়ে আয়কর খাতে বেশি আদায় হয়েছে। কারণ গত বছরের একই সময়ে আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ শতাংশ। সূত্র বলেছে, সরকারের বেশ কয়টি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় আয়করে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে আমদানি শুল্কে ঘাটতি হয়েছে ৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা, ভ্যাটে ৪ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ৪ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন খাতে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা।
সালমান/