![অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যাত্রা শুরু হলো নতুন বছরের](uploads/2024/01/01/1704082053.economic.jpg)
সংকটের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলো নতুন বছর ২০২৪। মূল্যস্ফীতির চাপ, জ্বালানিসংকট, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হারে অস্থিতিশীলতা এসব তো রয়েছেই। তার সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি নতুন বছরেও চাপের মধ্যে থাকবে। সেই চাপ দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ধরে রাখাই হবে নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল করা ও সুদের হার সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সরকারের আয় কম, ব্যয় বেশি। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও ভালো ফল আসেনি। কারণ, সরকারি আয়ের প্রধান উৎস রাজস্ব আহরণের অবস্থা ভালো নয়। বড় ধরনের আর্থিক সংকটে আছে সরকার। সামনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে বাড়তি ব্যয় হবে। ফলে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থ জোগাড় করা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘নতুন বছরে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আয় বাড়ানো ও ব্যয় কমানো। চলতি বাজেট থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমানো সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। ডলারসংকট দূর করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের আয় বাড়াতে হলে রাজস্ব আদায়ে কিছু সংস্কার করতে হবে। আইন করে রাখলে হবে না, আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে আয় বাড়াতে পারছে না। এরই মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি পাঁচ মাসে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ঘাটতি বাড়বে। ফলে সরকারের আর্থিক চাপ আরও বাড়বে।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের আয় না বাড়লে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। এমনিতেই অর্থনীতির অবস্থা নড়বড়ে। নতুন বছরে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। রিজার্ভেও ভালো খবর নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বেকায়দায় আছে সরকার রিজার্ভ নিয়েও। ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানিসংকটের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হবে। দেখা দেবে অর্থনীতির মন্দা। এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। ফলে নতুন বছরে মন্দা সহসা কাটছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামান্য কমলেও নতুন বছরেও উচ্চমূল্যস্ফীতি বজায় থাকবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘নতুন বছরে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এ জন্য সরকারকে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, মূল্যস্ফীতি কমানো, টাকার বিনিময় হার স্বাভাবিক রাখা এবং সুদের হার সমন্বয় করা। যা প্রায় অসম্ভব। তাই নতুন বছরেও সরকার বড় ধরনের চাপে থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন বছরে তারল্য সংকট দূর করতে হবে এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। এবারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এত এত প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে যে, তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও অর্থ আছে। এখন এনবিআর এসব প্রার্থীর কাছ থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হয় তা দেখার বিষয়।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি আছে। নতুন বছরে রাজস্ব আদায়ে রাতারাতি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে তার পরিবেশ দেখছি না।’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী ডলারসংকট দেখা দিয়েছে। দেশের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ে। ডলারসংকট খুব শিগগির কমবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ডলারসংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না। সময়মতো অনেক পণ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাজারে পণ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা চলছে। হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকে। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনিবআর) রাজস্ব আদায়ে এরই মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি কাঁধে নিয়েই ২০২৪ সালে পা দিয়েছে সরকার। অর্থবছরের বাকি আছে আর ছয় মাস (জানুয়ারি-জুন)।
অর্থনীতির সঙ্গে রাজস্ব আহরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ১ শতাংশ বাড়লে রাজস্ব বাড়ে ৪ শতাংশ হারে। অর্থনীতির দুরবস্থা হলে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩১ শতাংশ আদায় হয়। বাকি ৬৯ শতাংশ আদায় করতে হবে ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত। এ হিসেবে নতুন বছরের ছয় মাস সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে বা প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৩০ শতাংশের বেশি, যা কখনোই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ।
তিনি বলেন, ‘ডলারসংকট আপাতত কাটছে বলে মনে হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমদানিতে এলসি বা ঋণপত্র খোলার পরিমাণ বাড়বে না। ফলে শুল্ক আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’
রাজস্ব বোর্ডের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে আমদানি শুল্কে ঘাটতি হয়েছে ৫ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, ভ্যাটে ৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ৬ হাজার ১১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন খাতে পাঁচ মাসে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা।