আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ দেশ জাপানে বড় বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে খুব কম সময়ে কয়লা খালাস করা হয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কা, চীন ও ভারতের মতো দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুত কয়লা খালাসে অবস্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বড় বড় জাহাজে করে আসা কয়লা খালাস করা সম্ভব হচ্ছে মাত্র দেড় থেকে দুই দিনে। এমন প্রায় অসাধ্য সাধনের কাজ দেখে অবাক হয়েছেন কয়লা নিয়ে আসা বিদেশি জাহাজের নাবিকরাও।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসা ২২৯ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২ মিটার ড্রাফটের মতো বড় বড় জাহাজের হ্যাজ খুলে ‘আনলোডার’ নামক অত্যাধুনিক জাপানি মেশিনে কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে জাহাজ থেকে সরাসরি বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিজার্ভারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কয়লা। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে জাহাজ থেকে দ্রুত কয়লা খালাস করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিতে জাপান থেকে এই কনভেয়ার বেল্ট মেশিনটি আনা হয়। মেশিনটি প্রথম ব্যবহার করা হয় গত বছরের ২০ মে। সে সময় জাপানি যন্ত্রটির সাহায্যে হংকংয়ের পতাকাবাহী ‘এমভি ওয়াই এম ইন্ডেভোয়ার’ জাহাজ থেকে কয়লা খালাসে সময় লেগেছিল চার দিন।
সময়ের ব্যবধানে অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে কয়লা খালাসের সময়কালও। গত ২৭ জানুয়ারি মাতারবাড়ীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি এলান’ নামক জাহাজটি আসে। ওই জাহাজ থেকে কয়লা খালাসে সময় লেগেছে দুই দিন। বর্তমানে মাতারবাড়ীতে দেড় থেকে দুই দিনে জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করা সম্ভব হচ্ছে।
পানামার পতাকাবাহী জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) এন্টনি বিয়ানা জাবালা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এসে মাতারবাড়ী এলাকায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি। পাশাপাশি এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা কয়লা জাহাজ থেকে এত কম সময়ে খালাস হচ্ছে দেখে আমি আরও বেশি অবাক হয়েছি।’
মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসা কয়লাবাহী জাহাজগুলো জরিপ করে থাকে এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান। এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মকর্তা রকিবুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাতারবাড়ীতে প্রথম প্রথম কয়লা খালাস করতে চার দিনেরও বেশি সময় লাগত। এখন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে দেড় থেকে দুই দিনে এটা সম্ভব হচ্ছে। বিদেশিরাও এমনটা দেখে অবাক হচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য ভালো লাগার বিষয়। বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশও এগিয়ে যাচ্ছে।’
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা খালাসের দায়িত্বে রয়েছে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান পসকো কোম্পানি। বাংলাদেশে দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা, চীন ও ভারতে কয়লা খালাসে সময় লাগে ৪-৫ দিন। আর জাপানে লাগে দুই দিন। জাপানের পর এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই এত কম সময়ে কয়লা খালাস করা হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় প্রাপ্তির বিষয়।’
এক বছরে ২০ জাহাজে এল ১৩ লাখ টন কয়লা
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গত বছরের ২৬ এপ্রিল সর্বপ্রথম কয়লাবাহী জাহাজ আসে। এখন পর্যন্ত মাতারবাড়ীতে ২০টি জাহাজে করে মোট ১২ লাখ ৮৯ হাজার ১৪ টন কয়লা এসেছে।
সূত্র জানায়, গত বছরের ২৬ এপ্রিল ‘এমভি ওসুমারু’ নামক জাহাজে করে ৬৩ হাজার টন, ১৯ মার্চ ‘এমভি ওয়াই এম ইন্ডেভোয়ার’ জাহাজে ৬৫ হাজার ২৫০ টন, ২৭ এপ্রিল ‘এমভি ওসুমারু সেকেন্ড’ জাহাজে ৬৩ হাজার ৫০০ টন, ১৪ জুন ‘এমভি জিসিএল পারাদিপ’ জাহাজে ৬৪ হাজার ৭৭০ টন, ২৩ জুন ‘এমভি নেভিয়োস এম্বার’ জাহাজে ৫৪ হাজার ৯৫০ টন, ৪ জুলাই ‘এমভি এলএমজেড এটলাস’ জাহাজে ৬৫ হাজার ২০ টন, ১১ আগস্ট ‘এমভি মন্ডিয়াল সান’ জাহাজে ৬৪ হাজার ৯৩ টন, ২১ সেপ্টেম্বর ‘এমভি এলএমজেড বিয়ানকা’ জাহাজে ৬৪ হাজার ৩০০ টন, ২০ অক্টোবর ‘এমভি লরেন্স ফ্রাঙ্কোয়িস’ জাহাজে ৬৪ হাজার ৯৫০ টন ও গত ২৬ অক্টোবর ‘এমভি জিয়াকোমেটি’ জাহাজে ৬৩ হাজার ৫৫০ টন কয়লা আসে।
অন্যদিকে গত ১২ নভেম্বর ‘এমভি থাউজেন্ড স্প্রিং’ জাহাজে ৬৪ হাজার ২৭০ টন, ৩০ নভেম্বর ‘এমভি কোরিনা’ জাহাজে ৬৪ হাজার ২৬০ টন, ১১ ডিসেম্বর ‘এমভি লিটো’ জাহাজে ৬৩ হাজার ৩০০ টন, ১৭ ডিসেম্বর ‘এমভি মিয়ামা’ জাহাজে ৬২ হাজার ৯৩০ টন, ২৬ ডিসেম্বর ‘এমভি নভ লাক্সি’ জাহাজে ৬৫ হাজার টন, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ‘এমভি এসএসআই সারপ্রাইজ’ জাহাজে ৬৪ হাজার ৫৫০ টন, ২৭ জানুয়ারি ‘এমভি এলান’ জাহাজে ৬৪ হাজার ৩৫০ টন, ১১ মার্চ ‘এমভি জো ইউয়ান’ জাহাজে ৬৮ হাজার ৩২৬ টন, ২৪ মার্চ ‘এমভি অর্ডু’ জাহাজে ৬৩ হাজার ৯৪৫ টন ও ১ এপ্রিল ‘এমভি নেভিয়োস হেরাক্লেস’ জাহাজে করে আসে ৬৪ হাজার ৭০০ টন কয়লা।