![কেএনএফ সদস্যদের নাম নেই সাত মামলায়](uploads/2024/04/07/1712469446.KNF.jpg)
বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় দফায় দফায় ব্যাংকে হামলা, টাকা ও অস্ত্র লুট এবং ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে অপহরণের ঘটনায় ৭টি মামলা হলেও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) কোনো নেতা ও সশস্ত্র সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও র্যাব ওই সব ঘটনায় কেএনএফ-সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা বললেও রুমায় ৪টি ও থানচিতে ৩টিসহ ৭টি মামলায় অজ্ঞাতনামা ১৮০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তবে এতে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কেএনএফ সদস্যের নাম নেই।
গত শুক্রবার রাতে বান্দরবান জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া মামলাসংক্রান্ত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কুকি-চিন সদস্যদের নাম না থাকার বিষয়টি জানা যায়।
এদিকে বান্দরবানের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে শনিবার (৬ এপ্রিল) রুমার সোনালী ব্যাংক শাখার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এ সময় তিনি বলেন, সশস্ত্র অবস্থায় পোশাক পরে ডাকাতি, এটা আনচ্যালেঞ্জ ছেড়ে দেব না। অন্যদিকে কেএনএফ পাশের দেশে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
শনিবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, পাশের দেশে ইতোমধ্যে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছিল তাদের অস্ত্রশস্ত্র এদের কাছে এসেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া কেএনএফের হামলা ও গোলাগুলির মুখে প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়ছেন থানচি উপজেলার অনেক মানুষ।
গত বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বান্দরবানের রুমা-থানচিতে ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় কুকি-চিন নামে একটি জঙ্গি সংগঠন জড়িত বলে জানা গেছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হামলা, ব্যাংকের টাকা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় রুমা থানায় গত ৫ এপ্রিল পুলিশ, আনসার, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ও মসজিদের ইমাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের ১৩০-১৫০ জন আসামিকে করে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ ও ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিভিন্ন ধারায় ৪টি মামলা দায়ের করেন। সেই সঙ্গে থানচি থানায় অজ্ঞাতনামা ডাকাত দলের ২৫-৩০ জনকে আসামি করে সোনালী, কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা ও পুলিশ বাদী হয়ে বিভিন্ন ধারায় তিনটিসহ মোট ৭টি মামলা দায়ের করেছে। আরও একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন।
এ বিষয়ে থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন বলেন, অজ্ঞাতদের আসামি করে থানচি থানায় ৩টি মামলা করা হয়েছে। আরও একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। আসামি ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
মামলায় বলা হয়, গত ২ এপ্রিল রাত সোয়া ৮টার দিকে ১৩০ থেকে ১৫০ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল রুমা বাজারস্থ সোনালী ব্যাংকের উত্তর দিক (বেথেলপাড়া) হতে হানা দেয়। বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগে তারা অতর্কিত হামলা ও মারধর করে অস্ত্রের মুখে পুলিশ, আনসার ও অন্য লোকজনকে জিম্মি করে ফেলে। আক্রমণকালে সোনালী ব্যাংকের ডিউটিরত গার্ড কনস্টেবলসহ ১০ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২টি এসএমজি ও ৬০ রাউন্ড গুলি, ৮টি চায়না রাইফেল ও ৩২০ রাউন্ড গুলি, আনসার সদস্যদের ৪টি শটগান ও ৩৫ রাউন্ড কার্তুজ লুট করে। এ সময় সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। হামলাকারী দলের সদস্যরা রাত সোয়া ৯টার লুট করা অস্ত্র, গুলি ও ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে ঘটনাস্থলের উত্তরে বেথেলপাড়ার দিকে চলে যায়।
বান্দরবান পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, রুমা, থানচির ঘটনার মামলায় জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
মামলায় আরও বলা হয়, গত ৩ এপ্রিল আনুমানিক ১২টা ৪০ মিনিটে ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি সশস্ত্র সংঘবদ্ধ ডাকাতদল থানচি থানাধীন সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালায়। এ সময় ১৫ হতে ২০ লাখ টাকা এবং কৃষি ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৩ লাখ টাকাসহ ব্যাংকের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও উপস্থিত লোকজনদের কাছ থেকে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫টি মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে শাহজাহানপাড়ার পাহাড়ি এলাকা দিয়ে চলে যায়।
এদিকে শনিবার রুমার সোনালী ব্যাংক পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আজ থেকে ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্রলুটের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ ছাড়া এ ঘটনার আগাম তথ্য দেওয়ার বিষয়ে গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একের পর এক কেএনএফের সশস্ত্র হামলার কারণে বান্দরবানে ৭টি উপজেলায় বসবাসরত মানুষের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক উপজেলায় মানুষ পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
আতঙ্কে থানচি ছাড়ছেন অনেকেই
বান্দরবানে কেএনএফের টানা হামলা ও গোলাগুলির মুখে প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়ছেন থানচি উপজেলার মানুষ। উপজেলা সদরের বেশ কিছু পরিবার ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়েছে। বন্ধ থানচি বাজারের অনেক দোকান। আতঙ্কে রয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষ। এদিকে কুকি-চিন নির্মূলে র্যাবের সর্বাত্মক অভিযানের ঘোষণায় আগামীতে বড় ধরনের সংঘাত হতে পারে বলে শঙ্কা অনেকের। বান্দরবানে গহিন পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী। নদীর মতোই শান্ত আর স্থির জীবনধারা এখানকার পাহাড়ি মানুষের। কিন্তু গত কয়েকদিন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিনের টানা হামলা, গোলাগুলি আর লুটপাটে ছেদ পড়েছে এদের জীবনধারায়। সবুজ পাহাড়জুড়ে এখন বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। থানচি থানার কয়েক শ গজ সামনেই এ পাড়া। গত তিন দিনে কয়েক দফা কুকি-চিনের গোলাগুলি স্বচক্ষে দেখেছেন এখানকার মানুষ। আগামীতে আবারও হামলার আশঙ্কায় প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন বেশির ভাগ মানুষ।
স্থানীয়রা বলেন, ‘আমাদের ভয় অনেক বেশি। বাজার এলাকায় থাকি, গোলাগুলি হয়। এদের অনেক সাহস। সবাই চলে গেছে, শুধু আমরাই আছি। পরিস্থিতি খুব খারাপ, কখন গুলি খেয়ে মরে যাই। সবাই খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। থানার সামনে দেখা যায় ছোট ছোট গাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে উঠছেন অনেকে। এলাকার অস্থায়ী শ্রমিক, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী প্রাণ হারানোর ভয়ে সবাই ছাড়ছেন সংঘাতপূর্ণ এ এলাকা। থানচি উপজেলা সদর বাজারে ছোট বড় মিলিয়ে ২৫০টিরও বেশি দোকান, মার্কেট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, তালাবদ্ধ অনেক দোকান। যারা খোলা রেখেছেন তাদেরও ক্রেতা নেই। আতঙ্কে বাজারে আসছেন না বাসিন্দারা। ঈদ ও বৈশাখের আগে এমন ঘটনায় লোকসানে পড়ার শঙ্কা সবার।’
থানচি ও রুমা থানা, উপজেলা সদর, বাজার কিংবা সড়ক সব জায়গায় এখন কড়া নিরাপত্তা। এখানকার অনেক পাড়া কুকি-চিনের শক্ত ঘাঁটি। পুলিশ জানায়, থানার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে সংগঠনটির সশস্ত্র সদস্যরা। যেকোনো সময় হামলা করতে পারে তারা।
থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দীন বলেন, ‘তারা থানচি থানার এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আত্মগোপনে আছে বলে আমরা সংবাদ পেয়েছি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিআইজি স্যার আমাদের সার্বক্ষণিক দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বান্দরবানে কুকি-চিনকে সর্বাত্মক নির্মূলে মাঠে অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছে র্যাব। তেমনটি হলে আগামীতে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা করছেন এখানকার বাসিন্দারা।
গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায় পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। তারা ব্যাংকের কর্মকর্তা, নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্তত ২০ জনকে মারধর করে। টাকার পাশাপাশি পুলিশের অস্ত্রও লুট করে। অপহরণ করে নিয়ে যায় ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দীনকে। যদিও প্রায় দুদিন পর তাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব। এর পর দিন দুপুরে রুমা থেকে ৮৩ কিলোমিটার দূরে থানচি উপজেলা সদরে কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা লুট করে তিনটি গাড়িতে আসা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
এ ঘটনার পর থেকে ওই দুই এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে দুদিন ধরে কয়েক দফায় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে রুমা ও থানচি উপজেলায়।