![ভূ-রাজনীতির সমীকরণ এখন আলোচনায়](uploads/2024/04/08/1712555031.KNF-news.jpg)
কুকি-চিনের সন্ত্রাসী তৎপরতা সম্প্রতি বেড়েছে। এদের কার্যক্রম বাংলাদেশ, মায়ানমার ও ভারতের মণিপুর রাজ্যেও চলমান। এ অবস্থায় আলোচনা হচ্ছে, তাদের শক্তির উৎস কোথায়? কুকিল্যান্ড নামের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষ কীভাবে তাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ সব প্রশ্নের পাশাপাশি ওই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির নানা সমীকরণ নিয়েও চলছে জোর আলোচনা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রতিবেশী মায়ানমারের চিন প্রদেশেও রয়েছে। এ ছাড়া ভারতের মণিপুরেও এদের তৎপরতা রয়েছে। দেশ দুটিতে যেসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে এই কেএনএফের।
কুকি-চিনের উইকিপিডিয়া পেইজে দেখা যায়, ‘কেএনএফ বম পার্টি নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় একটি নিষিদ্ধ জাতিগত সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যা চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হত্যা, লুটপাট, মুক্তিপণ দাবিসহ একাধিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে।’
উইকিপিডিয়ায় আরও বলা হয়, ‘২০১৭ সালে নাথান বম প্রতিষ্ঠিত কেএনএফ রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে বম জনগণের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতে, কেএনএফ মায়ানমারে কাচিন রাজ্য থেকে অস্ত্র পায় এবং কারেন বিদ্রোহীর সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। এর সশস্ত্র শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।’
কুকি চিনের স্লোগান ‘নো ফুল স্টেট, নো রেস্ট’। তাদের এই স্টেটের নাম কুকিল্যান্ড। কুকিল্যান্ড রাষ্ট্রের মানচিত্রে ভারতের মণিপুর রাজ্যও অন্তর্ভুক্ত। মূলত তিন দেশের সীমানা টার্গেট করে তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে। কুকিল্যান্ডের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত আছে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল, ভারতের মণিপুর এবং মায়ানমারের কিছু অঞ্চল। এর আগে শুধু বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আলাদা ভূখণ্ড হিসেবে মানচিত্র প্রকাশ করেছিল কেএনএফ।
এ অবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘কেএনএফ পাশের দেশের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী একটি দেশের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে ব্যাংক লুট, ডাকাতিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তারা।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তাবিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সন্ত্রাসীদের ব্যাংকে লুট ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ওই সব অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর উপস্থিতি সত্ত্বেও সেখানে দিনদুপুরে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের ৬০-৭০ জন সদস্য ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে কীভাবে ব্যাংক লুট করল, তা দ্রুত খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘সশস্ত্র এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ড সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। একটি সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যদের সেখানে সমবেত হওয়ার বিষয়ে কোনো গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেল না কেন? সেখানে কি কোনো টহল বাহিনী ছিল না? থাকলে, তারা জানল না কেন? আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। ভারত ও মায়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের সঙ্গে এখানকার কুকি-চিনের যোগসূত্র থাকা অমূলক নয়। কারণ তারা এই অঞ্চলের কুকি-চিন উপজাতি গোষ্ঠী এবং সংখ্যায় খুবই কম। ওই ডাকাতির ঘটনা আট-দশজন লোকের কাজ ছিল না, সেখানে সত্তর জনের মতো লোক ছিল।’
তবে প্রশ্ন হলো, এ দেশে তাদের যে জাতিগোষ্ঠী রয়েছে সেখান থেকে এত লোক জোগাড় করা সম্ভব নয়। কাজেই ওই ঘটনায় এখানকার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ভারত ও মায়ানমারের কুকি-চিন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারণ সীমান্তের ওপারেই ভারতের মিজোরাম, মণিপুর ও মায়ানমারের চিন রাজ্যে কুকি জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী অবস্থান। ভারত ও মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে তারা সশস্ত্র তৎপরতা চালায়। বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে এখানকার কুকি-চিনরা সীমান্তের ওপারে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় পায়। কারণ সেখানে তাদের সগোত্রীয়রা অনেক শক্তিশালী।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর ওই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম বর্তমানে অনেকটাই সীমিত। ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ-বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় স্পর্শকাতর ওই সব অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফের সামরিক বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কারণ শুধুমাত্র পুলিশের ওপর নির্ভর করে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘কেএনএফ-কে প্রতিবেশি কোনো দেশ মদদ দিচ্ছে না। কারণ এই গোষ্ঠী মায়ানমারের চিন প্রদেশে খুব উৎপাত করে আবার ভারতের মণিপুর রাজ্যেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালায়। কাজেই ভারত বা মায়ানমারের কুকি-চিনকে ইন্ধন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাকি রইল চীন। কেন চীন আমাদের বিরুদ্ধে কেএনএফকে মদদ দেবে? চীনের সঙ্গে কী আমাদের সম্পর্ক খারাপ? তা তো না।’
এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো দেশকে ইঙ্গিত করেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন প্রতিবেশী দেশের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এদের মদদ দেয়।’
ভূ-রাজনৈতিক কারণে কোনো দেশ তাদের মদদ দিচ্ছে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত না এমনটা জানিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারতের মণিপুরে যে সংকট, সেটা এখানকার কুকিদের প্রভাবিত করতে পারে। আমরা এর আগে দেখেছি, কোনো দেশ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে তারা পাশের দেশে আশ্রয় নেয়।’
আবদুর রশিদ আরও বলেন, ‘কেএনএফ একটি ক্রস বর্ডার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। এটি একটি ত্রিদেশীয় সংগঠন। তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে বান্দরবান এলাকার নিরাপত্তায় যে ঢিলেঢালা ভাব চলে এসেছিল তাতে আমি বিস্মিত। তারা এক দেশের শক্তি অন্য দেশে ব্যবহার করতে পারে। তাদের অবস্থান তিন দেশের সীমান্ত এলাকায়। ক্রস বর্ডার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হওয়ায় তারা অস্ত্র এবং অর্থের বিনিময় করে।’
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘কুকি-চিন আসলে অ্যাটেনশন চেয়েছে। কুকি-চিনের ক্ষমতা অন্যান্য গোষ্ঠীর চেয়ে কম। তারা এমন একটা সময়ে ঘটনা ঘটাল যখন সীমান্তের ওপারেই অস্থির অবস্থা। তারা ওপার থেকে উৎসাহিত হয়েছে। তারা অ্যাটেনশন চেয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে তারা ব্যাংক লুট করেছে। মানুষ মারেনি।’
তিনি বলেন, ‘তারা আলোচনায় আসতে চেয়েছে যাতে ভবিষ্যতে তাদের দর-কষাকষি করতে সুবিধা হয়। কারণ এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে, ক্ষমতা না দেখাতে পারলে গুরুত্ব পাওয়া যায় না। জাতীয় পর্যায়ে গোয়েন্দাদের সমন্বয়ের অভাব ছিল। তাছাড়া আমাদের কাউন্টার টেররিজম স্ট্র্যাটেজি নেই। এটা সার্বক্ষণিক গবেষণার একটা ব্যাপার। আশা করি কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবে। সম্প্রতি মায়ানমারে বিদ্রোহীদের সফলতা এসেছে। ভারতের মণিপুরেও বিদ্রোহীরা সক্রিয় হয়েছে সম্প্রতি। এ কারণে কুকি-চিনও উৎসাহিত হয়েছে। তাদের মধ্যে তো কথাবার্তা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট করেছে। এতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠীকে তারা সহযোগিতা করবে। এর ফলে ছোট গোষ্ঠীগুলোও অ্যাটেনশন চাইছে। ইস্যুটি একাধারে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক।’
শান্তি আলোচনার মধ্যেও বেপরোয়া
২০২৩ সালের ২৯ মে কেএনএফের সঙ্গে সমঝোতা করেছিল শান্তি স্থাপন কমিটির আহ্বায়ক ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের কমিটি। হতাশ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলছেন, ‘আমরা তাদের এই আচরণে হতাশ। তারা কেন সমঝোতা ভঙ্গ করল, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র এবং কমিটির সদস্যসচিব কাঞ্চন জয় তংচঙ্গ্যা বলেন, ‘গত মাসের ৫ তারিখেও তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ তখন দেখিনি। আর চলতি মাসের ২০ তারিখে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। চার দফা সমঝোতার মূল বিষয় ছিল চাঁদাবাজি ও আক্রমণ না করা, শান্তি বজায় রাখা।’