![দর্শক খরায় খাঁটি দর্শক](uploads/2024/03/14/1710393724.fan=ok.jpg)
পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের তেরছা আলোয় চিকচিক করছিল মাঠের পরিবেশ। এই আলো পূর্ব প্রান্তের খাঁ খাঁ গ্যালারিকে আরও প্রকট করে তুলল। যেখানে দর্শক নাই বললেই চলে। শুধু পশ্চিমের জায়ান্ট স্ক্রিনের আশপাশে হাজারখানেক লোক সাগরিকায় ঢেউ তোলার চেষ্টা করলেন। যদিও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই ভেন্যুর ইতিহাসের সঙ্গে বড্ড বেমানান।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যকার প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ। অথচ চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের গ্যালারি যেন শূন্যতার হাহাকার। ম্যাচ শুরু হওয়ার সময় গ্যালারিতে দর্শক ছিল টেনেটুনে শপাঁচেক। প্রথম ইনিংসের বিরতির পর তা বেড়ে দাঁড়ায় হাজার দুয়েক। টাইগারদের খেলা অথচ মাঠে নেই দর্শক। মূল কারণ হলো রোজা। এই অবস্থায় দিবারাত্রির ম্যাচ দেখা দর্শকদের জন্য মোটেও সুবিধাজনক নয়।
বিরূপ এমন পরিস্থিতির মধ্যে যারা মাঠে এসে খেলে দেখেছেন, তাদের পাগলাটে ফ্যান বলা যেতেই পারে। দেশের ক্রিকেটের প্রতি তাদের আবেগ কতটা তা বুঝা গেল কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে। হালি শহর থেকে খেলা দেখতে এসেছিলেন দুই বন্ধু। কিন্তু নাম প্রকাশ করতে দুজনের তীব্র আপত্তি। ছবি তো তুলতেই দিলেন না। কারণটা তাদের পারিবারিক। একজনের বাবা খেলাধুলা পছন্দ করেন না, তাই না বলে এসেছেন খেলা দেখতে। যদিও দুবাই থাকা এই প্রবাসী সেখানে বাংলাদেশের ম্যাচ হলে মিস করেন না।
আরেক বন্ধুর কারণটা বউকেন্দ্রিক। বউ স্টেডিয়ামে আসা পছন্দ করেন না। কিন্তু মিরাজ-তাসকিনদের টানে তিনি চলে এসেছেন খেলা দেখতে। মাথা ঝাকিয়ে তিনি বললেন, বউ জানলে খবর আছে আমার।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ক্রেজি ফ্যান বলে বিবেচিত টাইগার শোয়েব। বাঘের সাদৃশ্য পোশাক পরে গ্যালারি মাতান তিনি, হাতে থাকে লাল সবুজ পতাকা। তার মতো এক দর্শক পাওয়া গেল, তিনি টাইগার রবি। মুশফিকের দারুণ এই ভক্ত জানালেন, ‘যেখানে ক্রিকেট সেখানেই আমি। আমাকে টাইগার রবি বানিয়েছে এই ক্রিকেটাররাই। এরা আমার জান প্রাণ। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।’ শান্ত কেমন অধিনায়ক জানতে চাইলে অনেকটাই ক্ষোভ ঝাড়লেন তিনি, ‘মিরাজকে একটা ফরম্যাটে অধিনায়ক দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু দেওয়া হয়নি। এটা অন্যায় করা হয়েছে তার সঙ্গে।’
চাচা মাহিবুল্লাহর সঙ্গে খেলা দেখতে এসেছিল ক্লাস সেভেন পড়ুয়া সাইফুল ইসলাম। এই মাঠে খেলা হলে তার খেলা দেখা চাই। মিস হলেই কান্নাকাটি করে সে। তরুণ হার্ড হিটার তাওহীদ হৃদয়ের ব্যাটিং মুগ্ধতা ছড়ার তার শিশুমনে।
লিটন দাসের এক দল ভক্তের সঙ্গে দেখা গ্যালারির পশ্চিম প্রান্তে। রানা, অভি, সুখলাল, রাজিব ও চন্দ্র। এরা সবাই বন্ধু। সবার বংশের পদবি দাস। লিটনের খেলা মানেই সব কিছু বাদ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। বাউন্ডারি লাইনে লিটন দাস যখন ফিল্ডিং করছিলেন, লিটন দা, লিটন দা বলে খানিকের জন্য গ্যালারি প্রকম্পিত করলেন টেরি বাজারে থাকা এই পাঁচ বন্ধু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের মনটা অনেক বিষণ্ন। কারণ পছন্দের ক্রিকেটার ব্যাট হাতে কিছুই করতে পারেননি। প্রথম বলেই ফেরেন ইনসাইড এজ হয়ে।
বড় পুকুর থেকে মাথায় লম্বা হ্যাট পড়ে এসেছিলেন তারেক ও স্বপন। দুজনই বন্ধু। পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। কিন্তু সাগরিকায় খেলা হলে তাদের রুখা দায়। কিভাবে সব ম্যানেজ করেন এমন প্রশ্নে স্বপন বললেন, ‘আমাদের কাজ বেলা ১২টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সো, খেলা দেখায় কোনো প্যারা নাই। আর এক দিন কাজ না করলে আহামরি কিছু হবে না। বাংলাদেশের খেলা বলে কথা।’ মাছ নিয়ে কারবার হলেও অল্প পরিসরে নির্বাচকদের বিনে পয়সায় পরামর্শও দিলেন তারা। তাদের মতে, ‘যে প্লেয়ার সবচেয়ে ভালো, কিংবা ভালো পারফরম্যান্স করে তাকে অধিনায়কত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া উচিত না। এতে তার আসল খেলা হারিয়ে যায়।’
সবার শেষে কথা হলো ছোট্ট টাইগার ভক্ত আদিবের সঙ্গে। ছয় বছর বয়সী এই শিশু পড়ে কেজিতে। খেলা দেখতে এসেছে বড় ভাই ও বাবার সঙ্গে। বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর ভীষণ ভক্ত সে। আর সেটা পরখ করতেই একটা কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হলো তার দিকে, ‘বলো তো বাবা শান্তর জার্সি নাম্বার কত।’ আদিবের ঝটপট উত্তর, নাইনটি নাইন (৯৯)। খুলশি থেকে আসা আদিবের বাবার চোখের দিকে তাকালাম। সে দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল না ছিল ছেলেকে নিয়ে রাজ্যের তৃপ্তি।