![জাহাজভাঙা শিল্পে বছরে গড়ে মৃত্যু হয় ১৪ শ্রমিকের](uploads/2023/12/19/1702992226.Ctg.jpg)
দেশের জাহাজভাঙা শিল্পে বছরে গড়ে ১৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০০৫ সাল থেকে ২০২৩ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত ১৮ বছর ২ মাসে ২৫১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এ শিল্পে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৯ সালে। তবে এরপর থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর হার কমে এসেছে। তবে মৃত্যুহার কমার পেছনে কারণ হিসেবে শ্রমিকের উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে, নাকি দেশের জাহাজভাঙা শিল্পে ভাটা পড়েছে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত স্থানীয় অংশীজনদের সঙ্গে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা এ সেমিনারে জাহাজভাঙা শিল্প শ্রমিক, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, পরিবেশ অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ নানা শ্রেণির স্টকহোল্ডার অংশ নেন।
বিলসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ৯ বছরে ১২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ১৬ জন, ২০১৬-তে ১৮ জন, ২০১৭-তে ১৯ জন, ২০১৮-তে ১৩ জন ও ২০১৯ সালে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। তার মানে ২০১৫ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে শ্রমিকের মৃত্যু বেড়েছে জাহাজভাঙা শিল্পে। তবে এরপর থেকে কমে এসেছে। ২০২০ সালে ১০ জন, ২০২১-এ ৯ জন, ২০২২-এ ৭ জন ও ২০২৩ সালে ৭ জন। এই ৯ বছর গড়ে ১৩ দশমিক ৫৫ জনের মৃত্যু হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিহত শ্রমিকদের গড় বয়স ৩৭ দশমিক ৭৭ বছর। নিহতদের মধ্যে ৩ জন কাটারম্যান, ২ জন ফিটারম্যান, ১ জন ওয়্যার গ্রুপ শ্রমিক এবং ১ জন ইলেকট্রিশিয়ান। নিহতদের মধ্যে ৩ জনের পরিবার ৭ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। ১ জনের পরিবার ৬ লাখ টাকা পেয়েছেন। বাকি ৩ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বলে জানা গেলেও টাকার পরিমাণ জানা যায়নি।
ক্ষতিপূরণ সংক্রান্তে ট্রেড ইউনিয়ন সুপারিশ হিসেবে আইএলও কনভেনশন ১২১, মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন-১৮৫৫ এবং উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ জরুরি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শ্রমিকরা আহত হওয়ার পর প্রথমবার মালিকপক্ষ তাদের চিকিৎসা করালেও পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার জন্য তাদের নাগাল পাওয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে যোগাযোগ করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ফলে অধিকাংশ আহত শ্রমিক ফলোআপ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ শ্রম আইন অনুযায়ী আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত মজুরিসহ ছুটি পাওয়া মালিকের খরচে চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক আহত শ্রমিকের অধিকার রয়েছে। আহত শ্রমিকরা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেলে আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া আইনের বিধান রয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়, জাহাজভাঙা শিল্পে ২০২৩ সালে মোট ৩৫টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৭টি দুর্ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়। আর বাকি ২৮টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭ জনের পা ভেঙে গেছে, ২ জন মাথায় আঘাত পেয়েছেন, ২ জনের হাত ভেঙে গেছে, আগুনে দগ্ধ হয়েছেন ৩ জন, মালামাল আনলোডিং করার সময় আহত ২ জন ও সামান্য আহত হয়েছেন ১৩ জন।
এসব ছাড়াও জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের ৭টি বঞ্চনার শিকার হতে হয় বলে বিলসের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে। এগুলো হলো ১. তাদের নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেওয়া হয় না, ২. লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ ঠিকাদারদের অধীনে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়, বিধায় শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হয় এবং ঠিকাদারদের দায় মালিক পক্ষ প্রায়ই অস্বীকার করে, ৩. শ্রমিকদের সবেতনে ছুটি দেওয়া হয় না, ৪. ২০১৮ সালে ঘোষিত নিম্নতম মজুরি আজও বাস্তবায়ন হয়নি, ৫. অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নাই, ৬. ঠিকাদারদের অধীনের নিয়োজিত শ্রমিকরা অনেক সময় কাজের মজুরিও পান না। ৭. প্রায়ই শ্রমিকদের মৌখিক নির্দেশে চাকরিচ্যুত করা হয়।
২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের হংকং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর এবং পিএইচপি শিপ রিসাইক্লিংসহ আরও ৩টি শিপ ইয়ার্ড সনদ লাভসহ গ্রিন হওয়ায় জাহাজভাঙা শিল্পে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। তবে এসব গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বড়সংখ্যক শ্রমিক চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এসব চাকরিচ্যুত শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থান না হলে আবার নতুন করে সামাজিক সংকট তৈরি করবে। গ্রিন শিপ ইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে উন্নয়ন পরিলক্ষিত হলেও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে আরও ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। তবে গ্রিন শিপ ইয়ার্ডগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন, জাহাজ কাটায় উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে জাহাজ কাটা হয় বলে ইয়ার্ডে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং একই সঙ্গে পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদনে সাতটি সুপারিশ জানানো হয়- ১. শ্রমিকদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল করতে হবে, ২. কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টিম থাকতে হবে, ৩. শ্রমিকদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স থাকতে হবে, ৪. শ্রমিকদের জন্য যুগোপযোগী মজুরি নিশ্চিত করতে হবে, ৫. শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, ৬. শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করতে হবে, ৭. দৈনিক ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ না করানো এবং শ্রম বিধিমালা অনুসরণ করে প্রতি ঘণ্টা অন্তর ১৫ মিনিট বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া জাহাজভাঙা শিল্পে পরিবর্তন ও ন্যায়বিচার প্রয়োজন দাবি করে বলা হয়, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ সব ধরনের শ্রম অধিকার, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত করা গেলে জাহাজভাঙা শিল্পে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে তাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।