![ঢাবি-চবিতে ভর্তির সুযোগ পেলেন হতদরিদ্র পরিবারের তাহমিনা](uploads/2024/03/30/1711793067.du.jpg)
বাবা ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানের কর্মচারী। মাকেও সংসারের তাগিদে করতে হয় নানা কাজ। টিনের ঘরটি বর্ষার পানিতে ডুবে যায়। ঘরে নেই পড়শোনার ভালো পরিবেশ। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এতোসব প্রতিকূলতার মধ্যেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ ইদিলপুর গ্রামের তাহমিনা আক্তার মুন্নি। এ খবরে পুরো এলাকায় প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
তাহমিনা এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি ইউনিটে ১৮১তম ও সি ইউনিটে ৩১২তম হয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি ইউনিটে ৭৯তম এবং বি ইউনিটে ৪৫৪তম হয়েছেন।
তাহমিনার বাবা মো. মিজান শ্রবণপ্রতিবন্ধী। সীতাকুণ্ড পৌরসদর বাজারে একটি ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানে সামান্য বেতনে কাজ করেন তিনি। মা কোহিনুর বেগমও সংসারের প্রয়োজনে নানা কাজ করেন।
অতিদরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে এসে কিভাবে এই সাফল্য অর্জন করলেন? সেই গল্প তাহমিনার মুখে শুনেছে খবরের কাগজ। অদম্য ইচ্ছাশক্তি কিভাবে মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয়, মেধাবী শিক্ষার্থী তাহমিনা তার বড় উদাহরণ। এক সময় যারা তাকে বলতো তোকে দিয়ে লেখাপড়া হবে না, তোর মা-বাবা গরীব। তাদেরকে তাক লাগিয়ে সাফল্যকে নিজের করেছেন তাহমিনা।
তাহমিনা বড় হয়ে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার হতে চান। কেনইবা পুলিশ ক্যাডারে তার আগ্রহ জানতে চাইলে তাহমিনা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার বাবা একজন সামান্য ফলবিক্রেতা। ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় ফল বিক্রি করেন বাবা। আমার বাবার পেশা আমার কাছে সবচেয়ে বড়। আমি গর্বিত আমি ফলবিক্রেতার মেয়ে। কাজ করতে গিয়ে আমার বাবাকে অনেক সময় পুলিশের কাছে হেনস্তা হতে হয়েছে। সেসব কথা আমি বলতে চাইনা। আমি বড় হয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে সমাজের সেবা করতে চাই।’
২০০৬ সালের ২ এপ্রিল সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ ইদিলপুর গ্রামে জন্ম তাহমিনার। তার দুই বোন ও দুই ভাই। ২০২১ সালে তাহমিনা সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ব্যবসায়শিক্ষা বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ২০২৩ সালে একই বিভাগে সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন।
একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তাহমিনার স্বপ্ন জাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তণ ছাত্র মুসলিম উদ্দিন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সব সময় তাকে এবং তার পরিবারকে সবসময় সহোযোগিতা করেছেন।
তাহমিনা আক্তার বলেন, আমি দৈনন্দিন ১০ ঘন্টার উপর পড়াশোনা করতাম। ছাত্রজীবনে অনেক কষ্ট করেছি। একটি ভালো মানের ব্যাগ পাওয়া, ঘড়ি পাওয়া স্বপ্নের মতো ছিল। কতদিন না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। স্কুল থেকে এসেও না খেয়ে পড়তে বসেছি। আমাকে আমার চলার পথে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী মুসলিম মামাদের পরিবার। তারা আমাদের আত্মীয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। এরপর আমার শিক্ষক ও প্যাসিফিক জিন্স ফাউন্ডেশন। আমার শিক্ষকরা টিউশন ফি নিতেন না। আমি বই, খাতা, কলম পেতাম বিনামূল্যে। প্যাসিফিক জিন্স ফাউন্ডেশন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করার সুযোগ দিয়েছে। আমি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সবাই সম্মিলিতভাবে আমাকে সহযোগিতা না করলে আমার এতোদূর আসা সম্ভব হতোনা।
তাহমিনার মা কোহিনূর বেগম খবরের কাগজকে বলেন, মেয়েকে পড়াশোনা করাতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছি। শত ত্যাগের ফসল আমি পেয়েছি। মেয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ায় অনেক খুশি হয়েছি।
তার বাবা মো. মিজান বলেন, আমি অন্যের অধীনে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করি। যে পয়সা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মেয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এটা জেনে আমি খুবই খুশি হয়েছি। যেন আমার জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট আর না পাওয়ার বেদনা ধুয়েমুছে গেছে।
মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সুযোগ পেলে কিভাবে মেয়েকে ভর্তি করাবেন, বই কিনবেন, রাজধানীর ব্যয় বহন করবেন তা নিয়ে তিনি বরাবরই চিন্তিত। মেয়ে বড় হয়ে দেশের সেবা করুক সেটিই চান তাহমিনার বাবা।
তাহিমনার প্রতিবেশি মামা মুসলিম উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার মরহুমা আম্মা এই পরিবারকে খুবই স্নেহ করতেন। মমতা দেখাতেন। তাদের সঙ্গে আমাদের আত্নীয়ের মতো সম্পর্ক। আমি সবসময় তাহমিনাকে উৎসাহ, উদ্দীপনা দিতাম। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা বলে অনেক টানাপোড়েন থাকতো। সে যেন কখনো ভেঙে না পড়ে, হতাশ না হয় সেজন্য প্রেরণা দিতাম। তাকে পরামর্শ দিতাম, সাহস যোগাতাম, অভয় দিতাম ভালো করে পড়ার। তাহমিনা অদম্য স্পৃহার অধিকারী। তার মধ্যে আছে কঠোর অধ্যবসায় তথা পরিশ্রমের মানসিকতা। আমি দেখেছি বর্ষাকালে ঘর ভর্তি নোংরা পানি। এরপরও তাহমিনা বই খুলে বসে আছে। তার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগ পাওয়া আমার কাছে সাগরের তলদেশ থেকে মুক্তা তুলে আনার মতো।’
মনির/পপি/অমিয়/