দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রায় অর্ধশতকোটি টাকা খরচ করেও লক্ষ্মীপুরের মেঘনার মোহনায় রহমতখালী চ্যানেলের নাব্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এতে জোয়ার-ভাটার সময় হিসেব করেই এই চ্যানেল দিয়ে লঞ্চসহ বড় নৌযান চলাচল করতে হয়। ফলে নদী পারাপারে মালবাহী যানবাহন ও যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। স্থানীয়দের দাবি, ফেরি ও লঞ্চঘাটটি মজুচৌধুরীর হাট থেকে আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে মেঘনা নদীর মুখে স্থানান্তর করলে এ সংকট কেটে যাবে। তখন বছরের পর বছর অর্থ ব্যয় করে ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে না।
বিআইডব্লিওটিএর তথ্যমতে, মজুচৌধুরীর হাট ঘাট এলাকার সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার নদীর নাব্যসংকট দূর করতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ড্রেজিং শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। প্রথমে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর নৌপথের লক্ষ্মীপুর প্রান্তে ড্রেজিং শুরু করা হয়। মেঘনা নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ‘নাব্য উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ৩১ লাখ ঘনমিটার বালি ড্রেজিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এরই মধ্যে প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা হয়েছে। এখন চলছে ‘মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং’।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা বছরই লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট নৌরুট দিয়ে ভোলা-বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ যাতায়াত করেন। ফেরি, লঞ্চ ও সি-ট্রাক দিয়ে মালবাহী পরিবহন ও যাত্রীরা মেঘনা নদী পাড়ি দেন। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির গভীরতা কম থাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রহমতখালী চ্যানেল নাব্যসংকটে ভোগে। গভীরতা বাড়াতে ড্রেজিং প্রকল্প চলমান থাকলেও তা কাজে আসছে না। এতে এ চ্যালেনটিতে ভারী নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হয়।
জানা গেছে, এই ভোগান্তির অবসান চেয়ে রহমতখালী চ্যানেল থেকে লঞ্চ ও ফেরিঘাট সরিয়ে আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে মূল নদীর মোহনায় স্থানান্তরের সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয় থেকে আসা বিশেষজ্ঞ কমিটি। সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ফেরি ও লঞ্চঘাট স্থানান্তরের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে স্থান নির্বাচনের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ করছেন।
মজুচৌধুরীর হাটের সি-ট্রাকের কর্মকর্তা বশিরুল ইসলাম বলেন, ‘রহমতখালী চ্যানেলে পানি থাকে না। ভাটার সময় বসে থাকতে হয়। এই সুযোগ স্পিডবোট এবং ট্রলার মালিকরা কাজে লাগায়। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যাত্রী পারাপার করেন। ঘাটটি মেঘনা নদীর কাছাকাছি নিয়ে এলে সহজে যাত্রী পরিবহন করা যাবে।’
এ ঘাট থেকে ভোলায় চলাচলকারি লঞ্চ এমভি পারিজাতের মাস্টার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভাটার সময় লঞ্চ বন্ধ রাখতে হয়। ভাটা পড়লে মাঝে মধ্যে রহমতখালী চ্যানেলের মাঝখানে লঞ্চ আটকে যায়। তখন জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে সময় ব্যয় হচ্ছে। রহমতখালী চ্যানেলের গভীরতা না বাড়লে লঞ্চ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য ঘাটটি স্থানান্তর করা প্রয়োজন।’
ড্রেজিং কাজে নিয়োজিত বিআইডব্লিউটিএর উপসহকারী প্রকৌশলী হযরত হাসনাত নিপুণ বলেন, ‘বোরাক, চিত্রা, শিবসা ও গোমতী নামে চারটি অত্যাধুনিক ড্রেজারের মাধ্যমে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ড্রেজিং করা হচ্ছে। এর মধ্যে গোমতী ড্রেজারে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ড্রেজিং কার্যক্রম সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়।’
নদীর পানিতে পলির পরিমাণ বেশি জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এক বালতি জোয়ারের পানিতে এক মগ পলি জমে। এক-একটি জায়গায় পাঁচ-ছয়বার ড্রেজিং করেও নাব্য ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। তবু লঞ্চ ও ফেরি চলাচলের পথ পলিমুক্ত রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করা হচ্ছে। এখন মজুচৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট এলাকায় ড্রেজিং চলছে।’
এ ব্যাপারে প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘জেলা ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটি’র মাধ্যমে খনন করা মাটি সরানো হচ্ছে। প্রকল্পের নিয়ম অনুয়ায়ী মাটি মসজিদ, মাদ্রাসাসহ নিচু জমিতে দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে খনন করে পাওয়া মাটি সরানো সম্ভব হয়নি। প্রচুর পলির কারণে একই জায়গায় প্রতিবছর ড্রেজিং করতে হচ্ছে। এজন্য খনন করা মাটি রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেঘনা নদীর জোয়ারে পলি জমলেও উল্টো দিক থেকে পানির চাপ বাড়ছে না। কারণ ঘাট এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইসগেট দুটি বন্ধ থাকে। এ কারণে ভাটার সময় পানি নেমে গেলেও পলিগুলো জমে যাওয়ায় নাব্য ফিরছে না। এ কারণে ভাটার সময় এ চ্যানেল দিয়ে লঞ্চ, ফেরি ও সি-ট্রাক চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ চ্যানেল দিয়ে এসব যান চলাচল করে জোয়ার-ভাটার সময় হিসেব করে। ফলে নদী পারাপারে মালবাহী যানবাহন ও যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়।’