![বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয় এমপি আজীমকে, পরিকল্পনা দেড় মাসের](uploads/2024/05/23/MP-Azim-murder-1716451589.jpg)
ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে কলকাতায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। তবে তার দেহের খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। জানা যায়, হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে লাগেজে ভরে গুম করা হয়েছে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এমপি আজীম হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী তারই বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আখতারুজ্জামান শাহীন। তিনিই নিখুঁত ছক করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে। এ জন্য খরচ করেছেন ৫ কোটি টাকা।
মরদেহ উদ্ধার না হলেও সুনির্দিষ্ট কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও কলকাতা পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। হত্যার পর মরদেহ টুকরো টুকরো করে অজ্ঞাত স্থানে গুম করে খুনিরা।
এ ঘটনায় পুলিশ ঢাকার মোহাম্মদপুর ও সাভার থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন বলে জানা গেছে। তারা কলকাতায় গিয়ে কিলিং মিশন শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। আর এই পুরো কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন শাহীনের আত্মীয় আমানউল্লাহ নামে এক উচ্চশিক্ষিত পেশাদার খুনি। যিনি একাধিক খুনের দায়ে অন্তত ২০ বছর জেল খেটেছেন। তাকে গ্রেপ্তার করে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশে তিনজন ছাড়াও ভারতে আরও দুজনকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সেখানকার পুলিশ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরেই কলকাতার অভিজাত এলাকা নিউ টাউনের এই ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া যায়। শাহীনের ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটের দেয়ালে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।
পুলিশের জেরায় গ্রেপ্তার তিনজন স্বীকার করেন যে, কলকাতার যে ফ্ল্যাটটিতে তারা ছিলেন, সেখানেই বালিশচাপা দিয়ে খুন করা হয়েছে আজীমকে। এর পর লাশ টুকরো টুকরো করে চারটি ব্যাগে ভরে গায়েব করা হয়। পরে ওই তিনজন বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
দুই দেশের পুলিশের সন্দেহ, হত্যাকাণ্ডের পেছনে সোনা চোরাকারবারের লেনদেন নিয়ে বিরোধ।
আজীমের ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আখতরুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। গত ১০ মে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসেন তিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতায় বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেশ থেকে ছয়জনের একটি কিলিং স্কোয়াড ভারতে নিয়ে যান। পরে ব্যবসায়িক আলোচনা করতে ফ্ল্যাটে ডেকে এমপি আজীমকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করা হয় লাশ। এরপর উবার ভাড়া করে লাগেজে ভরে সেই লাশ গুম করেন কিলিং মিশনের সদস্যরা।
একটি সূত্র জানায়, এরই মধ্যে শাহীনের ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে একটি ডায়েরি জব্দ করা হয়েছে। সেখানে ভাড়াটে খুনির কাকে কত টাকা দিয়েছেন, সে হিসাবও আছে।
ভাড়াটে দুই খুনির পাসপোর্ট করে দিয়েছেন শাহীন
হত্যা ছকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ভাড়াটে দুই খুনি জিহাদ ওরফে জুয়েল ও সিয়ামের পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়েছেন শাহীন। এই দুইজন হত্যাকাণ্ডের সাত থেকে আট দিন আগে কলকাতায় যান।
আজীমকে হত্যা করা হয় ১৩ মে
গত ১২ মে দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে যান আজীম। সেদিন তিনি বরাহনগর থানা এলাকার মণ্ডলপাড়ায় বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। পরদিন দুপুরে তিনি চিকিৎসকের কাছে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হন। বিকেলে বাসায় ফেরার কথা থাকলেও এদিন তিনি ফিরেননি।
মিশনে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, ভারতে যাওয়ার পরদিন ১৩ মে আজীমকে হত্যা করা হয়। বন্ধু গোপালের বাসা থেকে বের হওয়ার পর কলকাতায় প্রথমে একটি সাদা গাড়িতে আজীমকে তুলে নেয় এক ব্যক্তি। ওই গাড়িতে চালক, এমপিসহ তিনজন ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর লাল আরেকটি গাড়িতে ওঠেন আজীম। ওই গাড়িতে আজীমের বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীনের বেয়াই সৈয়দ আমানুল্লাহ ছিলেন। এমপিরও পূর্বপরিচিত আমানুল্লাহ।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দুই দেশের গোয়েন্দারা বলছেন, ১৩ মে দুপুর পৌনে ১টার দিকে এমপিকে বহনকারী লাল গাড়িটি কলকাতার অভিজাত এলাকা নিউ টাউনের আবাসিক ভবন সঞ্জীবা গার্ডেনসে ঢোকে। বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে এমপির জুতা ও পলিথিনের দুটি বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে ওই বাসা থেকে আমানুল্লাহ ও কিলিং মিশনের আরেকজন বেরিয়ে আসেন।
গ্রেপ্তার তিনজনের বরাত গিয়ে গোয়েন্দারা সংবাদমাধ্যমকে জানান, হত্যার পর লাশের টুকরো চারটি ব্যাগে ভরা হয়। আরও দুটি ব্যাগ নিয়ে ১৪ মে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গ্রুপ।
কিলিং মিশনের প্রথম দল কলকাতায় যায় ৩০ এপ্রিল। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এমপি হত্যায় জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন আজীমের বাল্যবন্ধু শাহীন ও তার বেয়াই আমানুল্লাহ। হত্যার ১৩ দিন আগে গত ৩০ এপ্রিল শাহীন, তার ‘গার্লফ্রেন্ড’ সেলিস্তি রহমান ও আমানুল্লাহ কলকাতা যান। সেখানে নিউ টাউনে তারা শাহীনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে ওঠেন। তবে আমানুল্লাহ ও সেলিস্তিকে কলকাতায় রেখে ১০ মে বৈধ পথে বাংলাদেশে ফিরে আসেন শাহীন। মূলত কিলিং মিশনের অংশ হিসেবে ঘনিষ্ঠ সহচর আমানুল্লাহকে নিয়ে আগেভাগে কলকাতায় যান।
তবে সেলিস্তি রহমান সরাসরি আজীম হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেলিস্তির বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। তার বাড়ি টাঙ্গাইল।
কলকাতায় শাহীনের ফ্ল্যাটে যখন এমপিকে খুন করা হয়, তখন সেলিস্তি সেখানে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডের পর ওই কক্ষে যান সেলিস্তি। ব্লিচিং পাউডারের উৎকট গন্ধ পেয়ে তার কারণ অন্যদের কাছে জানতে চান তিনি। তখন খুনিরা তাকে জানায়, ফ্ল্যাটে একজন মলত্যাগ করেছে। ওই গন্ধ দূর করতে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয়েছে।
তবে ১৫ মে আমানুল্লাহর সঙ্গে একই ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন সেলিস্তি।
গ্রেপ্তার আমানুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, আজীমকে হত্যার জন্য শাহীনের সঙ্গে তার ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এ জন্য কিছু টাকা অগ্রিমও দিয়েছেন। হত্যার পর ঢাকায় এসে শাহীনের সঙ্গে দেখা করেন আমানুল্লাহ। ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। সেখান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
আমানুল্লাহ আরও জানান, ১২ মে এমপি আজীম কলকাতা যাবেন এটা আগে থেকেই জানতেন শাহীন। হত্যার প্রস্তুতি হিসেবে সেখানে চাপাতিও সংগ্রহ করে রাখেন। ভারতে যাওয়ার পর কৌশলে সংসদ সদস্যকে ফ্ল্যাটে ডেকে নেন। এরপর সিয়াম, ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ চাপাতির মুখে আজীমকে জিম্মি করে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেন। এ নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হলে হঠাৎ বালিশচাপা দিয়ে আজীমকে হত্যা করা হয়।
হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঘেটে খুনের রহস্য উদ্ঘাটন
কলকাতায় সংসদ সদস্য আজীম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা। হত্যা মিশনে জড়িত সন্দেহভাজন একজনের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ বাংলাদেশি গোয়েন্দার হাতে আসে। ওই নম্বরটি খুব ব্যবহৃত হয়। পরে ওই খুদেবার্তা ও ফোন নম্বরের সূত্র ধরে এমন একজনের খোঁজ মেলে, যিনি কিলিং মিশনে বড় ভূমিকা রাখেন। এর পর তার বিষয়টি ভারতীয় পুলিশকে জানানো হয়।
এদিকে আজীম হত্যার ঘটনায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেছে তার পরিবার। এরই মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
নারী পাচারের অভিযোগে এক সময় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন আজীম। স্বর্ণ চোরাচালানের বিরোধের জের ধরেই দেড় মাস আগে এ খুনের পরিকল্পনা করা হয়। আজীমের বিরুদ্ধে হুন্ডি কারবার, মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
লাশের সন্ধানে কলকাতা পুলিশ
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিদর্শক (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী সাংবাদিকদের বলেন, আজীমের লাশ এখনো পায়নি পুলিশ। তবে কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে তারা মনে করছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি জানান, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আজীম উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার রায়ের। সন্দীপের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি।
অন্য একটি সূত্র বলছে, চোরাচালান ও অপরাধজগতের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে শাহীন ব্যারাকপুর এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনসে বেনামে এই ফ্ল্যাটটি কেনেন। ফ্ল্যাটের মালিক হিসেবে ঘনিষ্ঠ সন্দীপ রায়ের নাম ব্যবহার করেন তিনি।
ওই ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে কী ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাননি অখিলেশ চতুর্বেদী।
তিনি বলেন, পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ তদন্ত শুরু করেছে। অগ্রগতিও হয়েছে। তবে তারা কবে বেরিয়ে গেলেন, সে বিষয়ে আমরা তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে পারছি না। এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ১৩ মে আজীম এখানে এসেছিলেন। তবে তার আগেও এসেছিলেন কি-না, সেটা আমরা এখনো জানি না।
আখতারুজ্জামান শাহীন এমপি আজীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম সেলিমের আপন ছোট ভাই। অগাধ বিত্তের মালিক শাহীন এলাকায় সবার কাছে রহস্যময় মানুষ। আর আমানুল্লাহর বাড়ি খুলনার ফুলতলা এলাকায়। তিনি সম্পর্কে শাহীনের বিয়াই।
অমিয়/