![জাপানে অভিবাসী হতে আগ্রহ বাড়ছে](uploads/2023/12/14/1702575281.japankk23.jpg)
জাপানে অভিবাসী হতে বিদেশি নাগরিকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপানের কর্মক্ষম জনশক্তি হ্রাস পাওয়ার কারণে সরকার অভিবাসীদের জাপানে আনতে চাইছে। সরকারের এই নীতি দেশটিতে অভিবাসনকে আরও সহজ করেছে বলে মনে করছেন তারা। এ কারণে গত পাঁচ বছর ধরে জাপানে অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে।
জাপান বিশ্বের উন্নত ও বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। বর্তমানে ৪ দশমিক ৪১ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জাপান। ১৯৬০, ৭০ ও ৮০-এর দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে জাপান। পরবর্তী দশকগুলোতে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। তবুও জাপান আরও প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। তবে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশটির প্রয়োজন দক্ষ জনবল।
অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে
গত পাঁচ বছরে জাপানে অভিবাসীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী শ্রমিকের ঘাটতি মেটাতে আরও বেশি বিদেশি কর্মী আসার ফলে ২০২৩ সালে জাপানে অভিবাসীর সংখ্যা ৩২ লাখ ছাড়িয়ে যায়। দেশটির ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস এজেন্সির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত জাপানে থাকা অভিবাসীর সংখ্যা ৩২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫৮ জন। এই সংখ্যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৬৪৫ জন বেশি।
এর মধ্যে আবাসিক অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, যার পরিমাণ ৮ লাখ ৮০ হাজার ১৭৮ জন। ডিসেম্বরের তুলনায় আবাসিক অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যাটাগরির অভিবাসীর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে জাতীয়তার হিসেবে চীনা অভিবাসীর সংখ্যা জাপানে সবচেয়ে বেশি, তারপরেই রয়েছে ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়া।
কেন অভিবাসী বাড়াতে চায় জাপান
পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাপান ২০৪০ সালের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি শ্রমিকের ঘাটতির সম্মুখীন হতে পারে। দেশটির জনশক্তির দ্রুত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে জাপান। জাপানের গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান রিক্রুট ওয়ার্কস ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুসারে ২০২৭ সাল থেকে কর্মক্ষম বয়সী জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমের চাহিদা স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও ২০২২ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে শ্রমিক সরবরাহ প্রায় ১২ শতাংশ হ্রাস পাবে। এসব কারণে অভিবাসীদের আগ্রহী করতে বিভিন্ন সুযোগ দিচ্ছে জাপান সরকার। সরকার এখন অভিবাসন বাড়াতে দক্ষ পেশাদারদের জন্য পয়েন্ট সিস্টেম চালু করেছে এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়াতে চাইছে।
জাপানে বাংলাদেশি অভিবাসী
জাপানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০২২ সালের হিসাবে জাপানে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন। তারা জাপানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ। জাপানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বেশির ভাগই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তারা নির্মাণ, উৎপাদন, পরিষেবা খাতে কাজ করেন। এ ছাড়া কিছু বাংলাদেশি জাপানে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও পেশাদার হিসেবেও কাজ করেন। তবে জাপানের অভিবাসন নীতিতে শিথিলতার ফলে জাপানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জাপানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের চাহিদাও বাড়বে।
জাপানে অন্য দেশের অভিবাসীর সংখ্যা
জাপানি সরকারের তথ্য ও পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপানে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল মোট ১ কোটি ৯৩ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ জন। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি দেশের অভিবাসীদের মধ্যে রয়েছে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, ভারত, নেপাল ও তাইওয়ান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, কাজাখস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, মঙ্গোলিয়ার নাগরিকও বসবাস করছেন জাপানে।
জাপানে অভিবাসীদের জন্য বাড়িঘরের দাম
জাপানে বাড়িঘরের দাম ব্যয়বহুল। জাপানের রাজধানী টোকিও বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরগুলোর মধ্যে একটি। তবে সেখানে অভিবাসীদের জন্য বাড়িঘরের দাম জাপানি নাগরিকদের তুলনায় কিছুটা কম। অভিবাসীদের জন্য বাড়িঘরের দাম বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে টোকিও, ওসাকা, নাগোয়া ইত্যাদি বড় শহরে বাড়িঘরের দাম বেশি। এ ছাড়া অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়ির চেয়ে কম।
২০২৩ সালের হিসাবে টোকিওতে এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ইয়েন (প্রায় ৮ থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার)। আর কিনতে গেলে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ইয়েন (প্রায় ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মার্কিন ডলার)। দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ইয়েন (প্রায় ১২ থেকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার)। এই ধরনের অ্যাপার্টমেন্টের ক্রয়মূল্য ৭০ কোটি থেকে ২০০ কোটি ইয়েন (প্রায় ৭০ লাখ থেকে ২ কোটি মার্কিন ডলার)। এ ছাড়া ওসাকাতে টোকিওর তুলনায় ১০ শতাংশ কম এবং নাগোয়াতে ওসাকার তুলনায় ১০ শতাংশ কম। এভাবে মূল শহর থেকে একটু দূরে গেলে বাড়িবাড়া, ক্রয়মূল্য তুলনামূলক কম হবে।
অভিবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা কেমন
জাপানের অভিবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ কিছু সুবিধা পান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাপানি সরকার অভিবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। এই প্রোগ্রামগুলো অভিবাসীদের জাপানে ব্যবসা করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি সরকার অভিবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে।
অভিবাসীরা জাপানকে কী দিচ্ছেন
জাপানের অভিবাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা পাওয়ার ফলে জাপানের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অভিবাসীদের নতুন ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি জাপানি ব্যবসায়ীদের তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম উন্নত করতে সহায়তা করছে। এ ছাড়া অভিবাসীরা জাপানি বাজারে নতুন পণ্য ও পরিষেবা প্রবর্তন করছে, যা জাপানি অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে।
অভিবাসী হতে গেলে আইনি প্রক্রিয়া কী
জাপানে অভিবাসী হতে গেলে আইনি পন্থা হলো জাপানি সরকারের নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এই নীতিমালাগুলো জাপানি সরকারের জাপান ইমিগ্রেশন অ্যান্ড নেচারালাইজেশন অ্যাক্টে বলা হয়েছে। অভিবাসী হতে হলে জাপানে প্রবেশের জন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভিসা থাকতে হবে। ভিসার ধরন নির্ভর করে অভিবাসীর উদ্দেশের ওপর। জাপানে বসবাস এবং কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত জাপানি ভাষার দক্ষতা থাকতে হবে; জাপানি সমাজে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
[সূত্র: নিক্কেই এশিয়া, জাপান টাইমস, ইকোনমিক টাইমস, জাপান সরকারের তথ্য ও পরিসংখ্যান বিভাগ, জাপানের অভিবাসন বিভাগ, জাপান ট্যুরিজম বোর্ড, জাপান হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন, জাপান রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন]