রাঙামাটি-বান্দরবান সড়কে চন্দ্রঘোনা ফেরির ওপর নির্ভরশীল কয়েক লাখ মানুষ। রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার কয়েক হাজার ছোট-বড় যানবাহন, ব্যবসা-বাণিজ্য আর লক্ষাধিক মানুষের প্রতিদিনের চলাচল এ ফেরির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ফেরি বিড়ম্বনায় যাতায়াত, জরুরি রোগী, কৃষিপণ্য ও মৌসুমি ফল পরিবহন নিয়ে প্রতিদিনই ভোগান্তিতে পড়ছেন দুই পাড়ের বাসিন্দারা।
২০১৭ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পরিদর্শন শেষে সেতু অথবা টানেল নির্মাণের আশ্বাস দিলেও দীর্ঘ সাত বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ফেরির তত্ত্বাবধায়ক রাঙামাটি সড়ক বিভাগ বলছে, সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
চন্দ্রঘোনা ফেরি দিয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাঙামাটি-কাপ্তাই-রাজস্থলী ও বান্দরবান জেলার মানুষই চলাচল করেন বেশি। স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও পর্যটকদের জন্য তিন পার্বত্য জেলা ঘুরে কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য এই পথটি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু প্রতিদিনই ফেরির বিড়ম্বনায় পড়ছেন দুই পাড়ের বাসিন্দারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছোট সাম্পানে যাতায়াত করতে গিয়ে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে তাদের। আবার বর্ষায় পাহাড়ি ঢল, অস্বাভাবিক জোয়ার ও শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকটে বন্ধ হয়ে পড়ে ফেরি চলাচল। এতে যোগাযোগ ও কৃষি বাণিজ্যেও দেখা দেয় ভোগান্তি।
তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই প্রতিদিন ফেরি দিয়ে পার হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রতিদিনের ভোগান্তি নিয়ে সঞ্চিত ক্ষোভের কথাই জানালেন তাদের কয়েকজন। মো. সেলিম নামে একজন বলেন, ‘ফেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যায়। একটা ব্রিজ হলে আমাদের দুর্ভোগ কমে যেত, অনেক উপকার হতো।’
ইসমাইল নামে আরেকজন বলেন, ‘ব্রিজ না থাকায় রোগী নিয়ে মানুষ রাতে দিনে অনেক কষ্ট হয়। পার হতে না পেরে অনেক রোগী মারাও যায়।’
সড়কপথের যাত্রী রাজস্থলী উপজেলার বাসিন্দা চন্দ্রমোহন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘ফেরির জন্য সময়মতো গন্তব্যে যাওয়া যায় না। যাত্রী কম হলে ফেরি চলাচল করে না। আবার বেশি হলেও জ্যামে আটকে থাকতে হয়, এভাবে ২-৩ ঘণ্টাও লেগে যায়।’
রাঙামাটির বাসিন্দা সুজিত চাকমা বলেন, ‘জোয়ার এলে পন্টুন ডুবে যায়। তখন পানি না নামা পর্যন্ত ফেরিতে পার হতে পারি না। যদি নৌকায় যেতে চাই তাহলে পুরো নৌকা রিজার্ভ করতে হয়। একটি মোটরসাইকেল পার করতে ২০০ টাকা খরচ হয়। এটা একটা বড় সমস্যা।’
১৯৮৪ সালে চন্দ্রঘোনা ফেরি সার্ভিস চালু করে রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ভোগান্তি না কমায় দীর্ঘ চার দশক ধরে সেখানে সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছেন স্থানীয়রা। তবে ২০১৭ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট পরিদর্শন শেষে সেতু অথবা টানেল নির্মাণের আশ্বাস দিলেও দীর্ঘ সাত বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়কের সঙ্গে এই সেতুতেই যুক্ত হবে বরক্লের ঠেগামুখ স্থলবন্দর সড়ক। যা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে শক্তিশালী অংশীদার হয়ে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিকে করবে সমৃদ্ধ। তাই আর আশ্বাসের ইন্দ্রজাল নয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত জনগুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নির্মাণের বাস্তবায়ন চান স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘ফেরি পারাপার করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় পড়ছে বিভিন্ন যানবাহন। বর্ষকালে নদী পার হওয়া খুব কষ্টদায়ক ও ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকেই মারা গেছেন নৌকা দুর্ঘটনায়। রাঙামাটি, বান্দরবান ও দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, প্রাণের দাবি ফেরির পরিবর্তে একটি সেতুর।’
রাইখালী বাজারের বাসিন্দা শওকত হোসেন বলেন, ‘দৈনিক কয়েক হাজার যানবাহন আর লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াত করে ফেরি দিয়ে। ব্রিজটা হয়ে গেলে দুর্ভোগ থাকবে না। ব্রিজ না থাকায় আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও ব্যাঘাত ঘটছে। সরকার যদি আমাদের দিকে একটু নজর দেয়, তাহলে ব্রিজ হয়ে যায়। আমাদের মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ দেশে অনেক কাজ করেছেন, যদি ব্রিজটার দিকে একটু নজর দেন, তাহলে মানুষ অনেক শান্তি পায়।’
ফেরির তত্ত্বাবধায়ক রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, ‘সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং থেকে কর্ণফুলী নদীর ওপর চন্দ্রঘোনা ফেরি চলাচলের স্থানে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
বর্তমানে কনসালটেন্সি স্টাডি করছে, তারপর ব্রিজের ডিজাইন, লে-আউট এবং ডিপিপি তৈরি হবে। আমাদের জানানো হয়েছে, ঢাকা হেডকোয়ার্টার থেকে খুব শিগগিরই তারা স্টাডি সম্পন্ন করবেন এবং প্রকল্প তৈরি করবেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাঙামাটির সঙ্গে বান্দরবান ও সীমান্ত সড়কের যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন হবে এবং এ অঞ্চলের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হবে।’