![শ্রবণশক্তিহীনদের আশার আলো](uploads/2024/06/06/Untitled-1-1717668931.jpg)
শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীদের আধুনিক চিকিৎসা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট। এটি শ্রবণসহায়ক একটি ইলেকট্রনিক মেডিকেল ডিভাইস, যা শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে কানের ভেতর প্রতিস্থাপন করা হলে শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়া যায়। কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও বাংলাদেশে হচ্ছে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট। লিখেছেন বাংলাদেশ ইএনটি হাসপাতাল লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ
বিশ্বে প্রতি এক হাজারে একজন বধিরতা নিয়ে জন্মায়। আবার প্রায় সমানসংখ্যক জনগোষ্ঠী শ্রুতিশক্তি নিয়ে জন্মালেও জীবদ্দশায় তারা কোনো না কোনো সময় বধিরে পরিণত হয়। বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ লোক বিভিন্ন মাত্রায় বধির। এর মধ্যে ৩০ লাখ লোক মারাত্মক বধিরতায় ভুগছে, যাদের অনেকেই ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে।
ককলিয়ার ইমপ্লান্ট কী?
ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। আলেসান্দ্রো ভল্টা, যিনি ইলেকট্রিক ব্যাটারির আবিষ্কারক, তিনিই এ বিষয়ে প্রথম কথা বলেন। মানুষের বিশেষ ইন্দ্রিয় যেমন- শোনা, দেখা, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ এগুলোর মধ্যে শুধু শোনাতেই এ পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।
যেসব ক্ষেত্রে অন্তঃকর্ণ সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায় অথচ অডিটরি নার্ভ বা স্নায়ু সক্ষম থাকে, সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান স্নায়ুকে কাজে লাগিয়ে শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে শ্রবণশক্তিকে পুনরুদ্ধার করার চিকিৎসাই ককলিয়ার ইমপ্লান্ট। এর দুটি অংশ থাকে।
একটি অংশ অপারেশন করে কানের ভেতর বসিয়ে দেন ইএনটি সার্জনরা। অপর অংশটি কানের পেছনে সেট করা হয়। এটি দুটি চুম্বক তারের যন্ত্রের সঙ্গে বাইরের যন্ত্রের একত্রে নির্দিষ্ট স্থানে থাকা নিশ্চিত করে। একটি মাইক্রোফোন থাকে, যা বাইরের শব্দকে সংগ্রহ করে। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কে শব্দ সংকেত পৌঁছায়।
ফলে শব্দ শোনা যায় প্রায় স্বাভাবিকের মতোই। একে বায়োনিক কানও বলে। পুরো প্রক্রিয়ার জন্য লাগে মাইক্রোফোন, সংযুক্ত তার, স্পিচ প্রসেসর, ট্রান্সমিটিং কয়েল, রিসিভার স্টিমুলেটর, ইলেকট্রোড, ককলিয়ার, অডিটরি নার্ভ প্রভৃতি।
শ্রুতিহীন কারা?
বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ- কানের এই তিনটি অংশ। অন্তঃকর্ণে থাকে ককলিয়ার, যা দেখতে অনেকটা শামুকের মতো। বাইরের শক্ত হাড়ের ভেতর থাকে অতিসংবেদনশীল মেমরেনাস ককলিয়ার। এটিই শোনার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। এই ককলিয়ার যখন তৈরি হয় না অথবা নষ্ট হয়ে যায়, তখন শোনার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে ভাষাও শিখতে পারে না। ককলিয়ার ড্যামেজ মানেই কানের ভেতরের শ্রবণের সব অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়া। একে সেনসরিনিউরাল হিয়ারিং লস বলে। তখন এই ককলিয়ারকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়।
যাদের জন্য প্রযোজ্য
কোনো ব্যক্তির পক্ষে সর্বোচ্চ কর্মকুশলতা দেখাতে চাই স্বাভাবিক শ্রুতিশক্তি। এর অন্যথা হলেই দেখা দিতে পারে প্রতিবন্ধিতা। দীর্ঘ সময় শ্রুতিহীনতার উপযুক্ত চিকিৎসা অনুপস্থিত ছিল। এখন মাত্র ১০-১২ মাসের শিশুর ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করা সম্ভব হচ্ছে। আর দশজন সুস্থ মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে।
সাধারণত নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য বা শর্ত সাপেক্ষে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করা যায়। যেমন-
যাদের দুই কানেই মারাত্মক শ্রুতিহীনতা রয়েছে এবং হিয়ারিং এইড বা ওষুধ প্রয়োগ করেও ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
কানে শোনার ক্ষেত্রে যাদের জন্মগত সমস্যা রয়েছে তাদের বেলায় ১০ মাস থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া বেশি বয়সী, যাদের শ্রবণশক্তি নেই, তারাও এ চিকিৎসায় ভালো শুনতে পান।
অন্তঃকর্ণ গঠনগত দিক দিয়ে স্বাভাবিক এবং অডিটরি নার্ভ কর্মক্ষম রয়েছে যাদের।
কানে ইনফেকশন বা অন্য কোনো রোগবালাই নেই যাদের।
সর্বোপরি যিনি কথা বলতে, শুনতে এবং স্পিচ রিডিং করতে উৎসাহী এবং ইমপ্লান্ট-পরবর্তী নিবিড় পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজি।
শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে যে কারও
সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় মায়ের রুবেলা, হাম, মাম্পস হলে, জন্মগত সিফিলিস থাকলে, মায়ের ভাইরাস সংক্রমণ হলে, নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম হলে শিশুটির শ্রবণশক্তির সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া প্রসবকাল যদি দীর্ঘ হয়, জন্মের পর যদি নবজাতকের অক্সিজেন কমে যায়, যদি খিঁচুনি বা মেনিনজাইটিস হয়, তাহলে ককলিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ছোট শিশুদের মারাত্মক ডায়রিয়াও শিশুকে বধির করে দিতে পারে। অন্তঃকর্ণের সমস্যা যেমন- মাথায় আঘাত, কানে ইনফেকশন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, বসন্ত-পরবর্তী জটিলতা হিসেবে বধিরতা দেখা দিতে পারে। আবার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ঠাণ্ডা, সর্দি, স্নায়ুতন্ত্রের টিউমার কিংবা আঘাত, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ অনেক অজানা কারণে ককলিয়ার নষ্ট হয়ে শোনার ক্ষমতা হারাতে পারে যে কেউ। এ জন্য সতর্কতা হিসেবে সময়মতো মা ও শিশুকে ক্ষতিকর ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া, জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখা, ডায়রিয়ার সঠিক চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়।
খরচ
২০০৬ সালে আমরাই সর্বপ্রথম মিটফোর্ড হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের উদ্যোগে সফলভাবে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে (বিএসএমএমইউ) বিশেষ বাছাই প্রক্রিয়ায় ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) অনুদানের মাধ্যমে এ সার্জারি হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে সোবহানবাগ বাংলাদেশ ইএনটি হাসপাতালে এ অপারেশন হচ্ছে, যাতে খরচ পড়ছে সাড়ে ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা।
সফলতা ও ঝুঁকি
ককলিয়ার ইমপ্লান্টের চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ নিরাপদ ও কার্যকর। তবে ব্যক্তিভেদে এর ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে জটিলতাও দেখা দিতে পারে। এটি নির্ভর করে বধিরতা দেখা দেওয়ার বয়সকাল, স্থায়িত্ব, বয়স, বিদ্যমান অডিটরি নার্ভের কর্মক্ষমতা, যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রভৃতির ওপর।
সতর্কতা ও করণীয়
ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করালে ডিভাইসটি সাধারণত আমৃত্যু কার্যকর থাকে। তবে বিভিন্ন কারণে সমস্যা হতে পারে। এর জন্য ডিভাইসটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করাসহ কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেমন-
এটি যেহেতু ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ডিভাইস তাই ইলেকট্রিক শক থেকে দূরে থাকা উচিত।
যন্ত্রটিকে সবসময় শুকনো রাখতে হয়। কাপড় দিয়ে মুছে ড্রাই এইড বক্সে যত্ন করে প্রতিদিন রাখা উচিত। প্রচণ্ড গরম, আর্দ্রতা, ঘাম বা অন্য কোনো কারণে কোনো ক্ষতি যেন না হয়।
কানে জোরে আঘাত পেলে ইমপ্লান্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ জন্য খেলাধুলার সময়ও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
ব্যাটারি পরিবর্তন করতে হয় মাঝে মধ্যে। রিচার্জেবল ব্যাটারিও লাগানো যায়। ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জ করা ভালো।
সপ্তাহে অন্তত এক দিন নরম ব্রাশ দিয়ে যন্ত্রের বাইরের মাইক্রোফোন, ব্যাটারি কন্ট্রাক্ট ও ট্রান্সমেটিং কয়েলসহ বিভিন্ন জায়গা পরিষ্কার করা ভালো, যাতে ধুলোবালি না লাগে।
কানের সংক্রমণ বা পুঁজ হওয়া থেকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়। এ জন্য সর্দি লাগলে বা কানের ব্যথা হলে ভালোভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।
নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। কেননা অপারেশনের পর (৪-৬ সপ্তাহ পরে) ডিভাইসটিকে চালু করা হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি সপ্তাহে একবার করে দুই বা তিন মাস পর্যন্ত সেন্টারে আসতে হয়। তবে যন্ত্রটি ব্যবহারে তারা পারদর্শী হয়ে উঠলে তখন স্পিচ প্রসেসরটিকে বারবার ম্যাপিং বা প্রোগ্রামিং করার দরকার পড়ে না। তখন প্রতি ৬ থেকে ১২ মাস অন্তর আসতে হয়।
শিশুদের ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে শোনা, কথা বলা এবং ভাষাবিষয়ক নির্দেশনা চালিয়ে যেতে হয়, যতদিন প্রয়োজন পড়ে ততদিন পর্যন্ত এমনকি কয়েক বছর ধরে।
এমআরআই করতে বিশেষ সতর্কতা গ্রহণ করতে হয়।
না শুনলে করণীয়
পঞ্চইন্দ্রিয়ের অন্যতম বাকশক্তি। দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি কানে না শুনে বা কথা বলতে না পারে, তবে যত দ্রুত সম্ভব ইএনটি চিকিৎসকদের দেখানো উচিত। কেননা শিশুদের ভাষা শেখার জন্য এ সময়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশু কথা শুনে শুনে ভাষা শিখে। সে যদি কিছু শুনতে না-ই পায়, তবে তার ভাষার বিকাশটাও হয় না। সে ক্ষেত্রে হিয়ারিং এইড দিতে হয় এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
গ্রন্থনা: হৃদয় জাহান
কলি