![থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যা ও করণীয়](uploads/2024/05/30/ni-ra-1717075535.jpg)
থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ফরিদ উদ্দিন
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানব শরীরের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ থাইরয়েড হরমোন। এটি কম-বেশি হলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই নির্দিষ্ট মাত্রায় থাইরয়েড হরমোন থাকা খুব জরুরি। শরীরের বিভিন্ন কোষে শর্করা, আমিষ ও স্নেহ-জাতীয় খাবারের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করাই এর কাজ। এটি মানব শরীরের বৃদ্ধি, স্নায়ুর গঠন, যৌন ক্ষমতা, প্রজনন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েড হরমোন বেড়ে গেলে, ওজন হ্রাস, ক্ষয় হওয়া, মাসিকের সমস্যা ও চোখ ভয়ংকরভাবে বড় হয়ে যেতে পারে। বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণও এই থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয় থাইরয়েড নামক গ্রন্থি থেকে। এই গ্রন্থি গলার সামনের উঁচু হাড়ের পেছনের দিকে ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালিকে প্যাঁচিয়ে থাকে।
থাইরয়েডের হরমোনজনিত সমস্যাকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতাজনিত সমস্যা
থাইরয়েডের গঠনগত সমস্যা (যেমন- গলগণ্ড)
থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ
থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যানসার।
থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতাবিষয়ক সমস্যা দুই রকম হতে পারে। যেমন- হাইপোথাইরয়েডিজম ও হাইপারথাইরয়েডিজম।
হাইপোথাইরয়েডিজম
হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েডের লঘু ক্রিয়া হলো থাইরয়েডের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ রোগে পুরুষের চেয়ে নারীরা কয়েক গুণ বেশি ভোগে।
কারণ
কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম বা জন্মগত থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি।
থাইরয়েড হরমোনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সক্রিয় হলে (একে অটোইমিউন হাইপোথাইরয়েডিজম বলে)।
অপারেশনের কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণেও থাইরয়েড নষ্ট হয়ে গেলে।
মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি যথেষ্ট টিএসএইচ নিঃসরণ না করলে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা থাকলে।
রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে।
লক্ষণ
অবসাদগ্রস্ত হওয়া, অলসতা বা ঘুম ঘুমভাব।
ওজন বেড়ে যাওয়া।
পায়ে পানি আসা।
ক্ষুধামান্দ্য।
চুল পড়া।
ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া।
মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
কোষ্ঠ কাঠিন্য।
রক্তচাপ বৃদ্ধি।
বন্ধ্যত্ব।
গর্ভপাত।
শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া।
শরীরে শীত শীত ভাব।
অনিয়মিত পিরিয়ড ইত্যাদি।
হাইপারথাইরয়েডিজম
রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে হাইপারথাইরয়েডিজম হয়।
কারণ
প্রধান কারণ গ্রেভস ডিজিজ, যাতে অ্যান্টিবডি অতিরিক্ত মাত্রায় থাইরয়েডকে উত্তেজিত করলে হাইপারথাইরয়েডিজমের সমস্যা দেখা দেয়।
অন্যান্য কারণের মধ্যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ, ওষুধের প্রতিক্রিয়া, টিউমার ইত্যাদি।
লক্ষণ
ক্ষুধা বেড়ে গেলেও ওজন কমে।
শরীরে গরম অনুভব।
বুক ধড়ফড় করা।
মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
ত্বক কালো হয়ে যাওয়া।
ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়া।
চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসা।
অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
পিরিয়ডের সমস্যা।
বন্ধ্যত্ব।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
থাইরয়েড গ্রন্থি ও হরমোনের বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে নিচের পরীক্ষাগুলো করা হয়।
রক্তে হরমোনের মাত্রা।
আল্ট্রাসনোগ্রাম।
রেডিও-অ্যাকটিভ আয়োডিন আপটেক ও স্ক্যানটেস্ট।
এফএনএসি।
চিকিৎসা
হাইপো বা হাইপার দুই ক্ষেত্রেই ওষুধের মাধ্যমে থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতার চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে ওষুধে কাজ না করলে সার্জারি বা রেডিও-অ্যাকটিভ আয়োডিনথেরাপি দেওয়া হয়।
থাইরয়েড গ্রন্থির গঠনগত সমস্যা
থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গেলে তাকে থাইরয়েড নডিউল বলে। অনেক সময় হরমোন নরমাল থেকেও থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। সাধারণত আয়োডিনের অভাবে গলাফোলা রোগ হয়ে থাকে। যাকে সাধারণ ভাষায় বলে ঘ্যাগ বা গলগণ্ড রোগ।
আয়োডিনের অভাব
বাংলাদেশের মানুষ আয়োডিনযুক্ত লবণ খাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ স্কুলগামী শিশু ও গর্ভবতী মায়ের আয়োডিনের অভাব রয়ে গেছে। এ আয়োডিন শরীরে অতিপ্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুঃখের বিষয়, সারা পৃথিবীতে এখনো দুই হাজার মিলিয়ন মানুষ আয়োডিনের অভাবে ভুগছে। কিছু কিছু জিনগত কারণেও থাইরয়েড নডিউল হতে পারে। আবার থাইরয়েড নডিউল বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট (ক্যানসার) দুই রকমই হতে পারে।
চিকিৎসা
সময়মতো রোগ নির্ণয় করা গেলে থাইরয়েড নডিউল বা ক্যানসার নিরাময় করা যায়। বিনাইন নডিউলের চিকিৎসা রোগ অনুযায়ী ওষুধ দ্বারা অথবা নডিউল থেকে পানি বের করে অথবা রেডিও-অ্যাকটিভ আয়োডিন সেবনের মাধ্যমে করা হয়। ক্যানসার হলে অপারেশন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। অনেক ক্যানসারের ক্ষেত্রে রেডিও-অ্যাকটিভ আয়োডিন সেবনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে থাইরয়েড হরমোনের সব ধরনের চিকিৎসাই দীর্ঘদিন থেকে হয়ে আসছে। এ জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
অনুলিখন: হৃদয় জাহান
কলি