আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগে নরম সুর দেখা যাচ্ছে।
শনিবার (৪ মে) পর্যন্ত স্বজনদের বিষয়ে করণীয় নিয়ে দলটি কিছুই স্পষ্ট করেনি। দলীয় সূত্র বলছে, এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা প্রার্থী হতে পারবেন না, প্রার্থী হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আগে বলা হলেও এখন দলের নেতারা বলছেন ‘প্রভাবিত করলে’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের এই নরম সুরের কারণ, গত ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে এ বিষয়ে সেদিন স্পষ্ট করে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি বরং দলের এক নেতা বৈঠকে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী হাত তুলে তাকে বসতে বলেন। এ বিষয়ে পরে কথা হবে বলেও জানান শেখ হাসিনা।
এক দিন পর, ২ মে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের অংশ নেওয়া-না নেওয়া প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। তারা আগে নির্বাচন করেছেন। কেউ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, কেউ উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের তো রাজনৈতিক জীবন আছে। তাদের মানা করি কী করে? তবে এটা ঠিক, এক জায়গায় বউকে দিল, আরেক জায়গায় ছেলেকে দিল, এগুলো ঠিক না। কর্মীদের মূল্যায়ন করা উচিত। সেটাই নেতা-কর্মীদের বলতে চেয়েছি।
উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের দলীয় নির্দেশনাসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা আরও বলেন, পারিবারিক ফর্মুলায় কারা পড়েন? নিজের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী, এই তো? হিসাব করে দেখেন কয়জন ছেলে-মেয়ে, কয়জন স্ত্রী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন? এর বাইরে তো পরিবার ধরা হয় না। আমাদের কথা হচ্ছে নির্বাচন যেন প্রভাবমুক্ত হয়। মানুষ যেন স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর দলের নেতারা অনেকটা চুপসে গেছেন। তাদের বক্তব্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের বিষয়ে দলে আলোচনা ছিল। নেত্রী (শেখ হাসিনা) স্বজনদের বিষয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এর আগে কৌশলগত কারণে দলের সাধারণ সম্পাদক একটি নির্দেশনা দিয়েছেন, এখনো আবার কৌশল নিয়েছেন- আমরা সেটা মেনে চলছি।’ এ বিষয়ে দলের অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে বাস্তবতার আলোকে পরিস্থিত বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। এর বাইরে আর কোনো বক্তব্য নেই।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই মুহূর্তে শান্তিপূর্ণ, অর্থবহ ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা আমাদের লক্ষ্য। নির্বাচনের পরে দলের নির্দেশ অমান্যকারীদের বিষয়ে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, তৃণমূল পর্যায়ে বিতর্ক ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এড়াতে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের বিষয়ে কঠোর না হয়ে এখন নরম হওয়ার পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ। এখন দলের নজর উপজেলা নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা। কারণ নির্বাচনে দলের অনেক এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের পরিবারের সদস্যরাও আছেন। যদি এ বিষয়ে আওয়ামী প্রধান কঠোর সিদ্ধান্ত দিতেন তাহলে দলের তৃণমূলে ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে যেত। গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তা এখনো মেটানো যায়নি। তাই নতুন করে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে সরাসরি হার্ডলাইনে যাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তবে দল অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে।
৩০ এপ্রিলের বৈঠকে উপজেলা নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে কোনো গ্রুপিং করা যাবে না। যেখানে গ্রুপিং আছে সেখানে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে হবে। না হলে দলেরই ক্ষতি। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী ও এমপিদের নিকটাত্মীয় এবং স্বজনদের প্রার্থী না হতে দলীয় যে নির্দেশনা, তা না মানলে সময়মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২৪ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমন বক্তব্যের পাশাপাশি আরও বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনে প্রথম পর্যায়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন যে, আমরা বিষয়টি আরও আগে অবহিত হলে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। তার পরও কেউ কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন, কেউ কেউ করেননি। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া সময় শেষ হয়ে গেলে কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারেন না। এই বিষয়টি চূড়ান্ত হতে নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখানে কেউ অমান্য করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ জন্য তালিকাও তৈরি করছেন।
তবে গত শুক্রবার জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে কোনো অবস্থান স্পষ্ট করেননি। তিনি বলেছেন, ‘অনেকেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে শুরু করেছেন। আমাদের কয়েকজন আগেই প্রত্যাহার করেছেন। আমাদের গোলাম দস্তগীরের ছেলে প্রত্যাহার করেছেন।’
ওই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, আমার স্বজনও একজন উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। সেখানে প্রশ্নটা হচ্ছে, আমাদের সমর্থন আছে কি না? আমি তার পক্ষে প্রশাসন বা নির্বাচনকে প্রভাবিত করছি কি না, সেটাই দেখার বিষয়।’ তিনি বলেন, পার্টির কারও এর সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই, নেতৃস্থানীয় কারও এর সঙ্গে কোনো সমর্থন নেই। আমার সমর্থনের তো প্রশ্নই ওঠে না।’ প্রভাবিত করলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়েও পরিষ্কার করেননি ওবায়দুল কাদের।
দলীয় নির্দেশ অমান্য করে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই ও ভাগনে। ছোট ভাই শাহদাত হোসেন প্রার্থী হয়েছেন চেয়ারম্যান পদে। আর ভাগনে (আপন বোনের ছেলে) মাহবুবুর রশীদ মঞ্জু প্রার্থী হয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান পদে।
এদিকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল চাইছে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত রাখতে। বিএনপিবিহীন ভোটে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রশ্ন রাখতে চায় না দলটির হাইকমান্ড। দলের নেতাদের সে বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।