![রাজশাহীতে আওয়ামী লীগে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে](uploads/2024/06/30/awami-league-1719718028.jpg)
রাজশাহীতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্য ও সহিংস রূপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় সমঝোতা বিনষ্টের জন্য উভয় পক্ষই পরস্পরকে দুষছে। গত ২২ জুন দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়ে বাঘা উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কোন্দল চরমে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে বাবুল হত্যার মদদদাতা হিসেবে সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে দায়ী করে রাজশাহী-৬ আসনের এমপি শাহরিয়ার আলম বক্তব্য দিলে বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতে শাহরিয়ার আলমের শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী।
বিভক্ত আওয়ামী লীগের এক বলয়ে আছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী-৩ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, রাজশাহী-২ আসনের এমপি ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনীল কুমার, রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি এনামুল হক প্রমুখ।
আরেক বলয়ে রয়েছেন রাজশাহী-৫ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা, রাজশাহী-৬ আসনের এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, রাজশাহী-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফারুক চৌধুরী, রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আয়েন উদ্দিন প্রমুখ।
জানা যায়, গত ২২ জুন বাঘায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘণ্টাব্যাপী চলা এই সংঘর্ষে স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলমের অনুসারী বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলসহ উভয় পক্ষের অর্ধশত নেতা-কর্মী আহত হন। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার মারা যান বাবুল। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বাঘা মডেল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বাবুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় লাশ সামনে রেখে বক্তব্য দিতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘খুনি আক্কাস (পৌর মেয়র), খুনি মেরাজ (ইউপি চেয়ারম্যান)। তাদের পেছন থেকে মদদদাতা হিসেবে আসাদুজ্জামান আসাদ, এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং লায়েব উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা হবে। তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।’
শাহরিয়ারের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বাবুল যখন ছাত্রনেতা, তখন থেকেই তাকে আমি পাশে পেয়েছি। তার নিন্দনীয়-নৃশংস হত্যার সঙ্গে আমার কোনোভাবে জড়িত থাকার কোনো কারণ নেই। জানাজায় আমার নাম ধরে এলাকার বর্তমান এমপির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঈর্ষাপরায়ণ এ রকম উক্তি আশা করিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন এই লাশটির দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক পক্ষের। যেটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এ রকম ষড়যন্ত্র একটা গোষ্ঠীর ছিল বা আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার।’
জানাজায় শাহরিয়ার আলমের বক্তব্যের বিষয়ে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘বাবুলের খুনের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, সবার বিচার হওয়া উচিত। সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম আমাদের মদদাতা হিসেবে উল্লেখ করে সাত দিনের কল রেকর্ড তুলতে বলেছেন। আমি ডিআইজি-এসপিকে ফোন করে বলেছি, সাত দিন না, সাত মাসের কল রেকর্ড তুলে দেখেন। শাহরিয়ার সাহেব যা বলেছেন, তা তাকে প্রমাণ করতে হবে; তা না হলে তাকেও মামলার মুখোমুখি হতে হবে।’
এদিকে খায়রুজ্জামান লিটনকে খুনের মদদদাতা উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলমের দেওয়া বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে রাজশাহীতে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। গতকাল শনিবার সকালে শাহরিয়ার আলমকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাজশাহী জেলা ও মহানগর ইউনিট কমান্ড। মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে অংশ নেয় সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড। এছাড়া বিকেলে নগরীর লক্ষ্মীপুর মোড়ে জেলার পবা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একাংশের উদ্যোগে ঝাড়ু মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন রাজশাহী মহানগর যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা শাহরিয়ার আলমকে রাজশাহীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার কুশপুতুল দাহ করেন।
অন্যদিকে বাঘায় সংঘর্ষ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল নিহতের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি দুটি মামলা হওয়ায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন দলের অনেক নেতা-কর্মী। জানা গেছে, ২২ জুন সংঘর্ষের পর রাতেই দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহিনুর ইসলাম পিন্টু থানায় মামলা করেন। মামলায় মেয়র আক্কাস আলী, ইউপি চেয়ারম্যান মেরাজুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মোকাদ্দেসসহ ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া আরও ২০০-৩০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়।
সংঘর্ষের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার আদালতে পাল্টা মামলা করেছে মেয়র পক্ষ। আবুল কালাম (৩৫) নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলার আরজিতে বলা হয়, ঘটনার দিনই তারা থানায় মামলা করতে যান, কিন্তু বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামলা গ্রহণ করেননি। তিনি আদালতে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী আদালতে এ মামলা করা হয়। এ মামলায় আসামি হিসেবে উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহিনুর রহমান, সদ্য অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে শাহরিয়ার আলম সমর্থিত পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী রোকনুজ্জামান রিন্টুসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১০০ থেকে ১৫০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। আদালতের বিচারক মো. হাদিউজ্জামান মামলার আবেদনটি গ্রহণ করে তা এজাহার হিসেবে রেকর্ড করতে বাঘা থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।
পুলিশ জানিয়েছে, আদালতে করা মামলার এজাহার তারা এখনো পায়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাঘা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা বলেন, ‘দলিল লেখক সমিতির সভাপতির করা মামলাটি আমি তদন্ত করছি। মেয়র পক্ষ আদালতে মামলা করেছে বলে শুনেছি। তবে আদালত থেকে এখনো নথিপত্র আসেনি। সেটা এলে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া সংঘর্ষের সময় যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই এখন পলাতক। কোনো পক্ষের লোকজনই এলাকায় নেই।’