গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। অন্যদিকে প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে একটি ধারণা ও আলোচনা ছিল যে আপাতত বেশ কয়েক বছর সরকার ঝামেলামুক্ত থাকছে। বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের মুখে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন অনেকে।
কিন্তু মাত্র চার মাসের মধ্যে পরপর সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায় বিএনপি কথা বলার ইস্যু পেয়েছে। তাই বলা হচ্ছে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘রাজনীতি’ করার সুযোগ পেয়েছে দলটি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের প্রভাবশালী আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের কলকাতায় খুন হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন, এসব ঘটনায় সরকার কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে। ইতোমধ্যে আজিজকে নিয়ে পরিস্থিতি আরও কিছুটা ঘোলাটে হয়েছে। কারণ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চেয়ে দুদকে আবেদন করা হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, “পরপর চারটি নির্বাচনে ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বিএনপির উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই ছিল না। কিন্তু আজিজ ও বেনজীরকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এবং এমপি খুনের ঘটনায় বিরোধী দলগুলোর কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক কথায় তারা ‘ব্রিদিং স্পেস’ পেয়েছে।” ওই তিনটি ঘটনাই সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে মনে করেন তিনি।
যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এসব ঘটনায় সরকার বিব্রত নয়। তবে তিনি এও বলেছেন, বেনজীরের বিষয়ে দুদক তদন্ত করছে, চাইলে আজিজেরও তদন্ত হতে পারে। ‘সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে এবং সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি’- এমন কথাও বলেন সরকারের এই সেতুমন্ত্রী।
তবে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ নিজে এ প্রসঙ্গে দেশের একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘সরকারকে বিব্রত ও হেয় করার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছেন।
জেনারেল (অব.) আজিজ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ তাদের ‘সরকারের ছায়া’ বলেও মনে করেন। ফলে দুজনের বিরুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং একজনের স্থাবর সম্পদ জব্দ ও তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শুরু হওয়ার ঘটনায় তারা বিস্মিত হয়েছেন। অনেকে এর কারণ ও তাৎপর্য খোঁজারও চেষ্টা করছেন। সংশয় প্রকাশ করে তাদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের ভেতরকার ক্ষমতাবলয়ের কোনো হিসাব-নিকাশের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে এই ঘটনা। আবার কারও মতে, ঘটনার নেপথ্যে শক্তিধর কোনো রাষ্ট্রের চাপ থাকতে পারে। কারণ ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু ও সময়ে হলেও আজিজ ও বেনজীর দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, ‘সরকারের ব্যর্থতার ফলেই সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক স্পেস পেয়েছে। কারণ সরকার একের পর এক ইস্যু নিজেরাই তৈরি করছে। সরকারের অপকর্মই সরকারের বড় শত্রু। এখানে বিরোধী দলের কোনো কৃতিত্ব নেই।’
‘তা ছাড়া অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, ভোটাধিকার হরণ, আইনের শাসনের অভাব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অভিযোগের মধ্যে ভঙ্গুর অবস্থায় সরকার দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ থাকাও অস্বাভাবিক নয়’ যোগ করেন সুধী সমাজের এই প্রতিনিধি।
পরপর সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায় বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে কি না- জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর কিছু নেই। কারণ দেশের জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে বলেই ভুয়া নির্বাচন করে তাদের ক্ষমতায় থাকতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বিষয় হলো তারা (সরকার) নিজেদের অপকর্মে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছে। সরকারের লোকদের এ রকম হাজার হাজার অপকর্মের ঘটনা রয়েছে; যা সময় হলে বেরিয়ে আসবে।’
আজিজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয় গত ২১ মে। কিন্তু গত ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের পর সরকারের মধ্যে একধরনের স্বস্তির ভাব দেখা গেছে। ওই সফরকে কেন্দ্র করে ‘যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান বদলায়নি’ বলে দাবি করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। আর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘লুর বক্তব্য পরিষ্কার, ফখরুলের বক্তব্যের কোনো মূল্য নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বিএনপি হতাশ। ‘দলটির নেতাদের মাথায় হাত উঠেছে’ এমন কথাও বলেছেন তিনি। কিন্তু ওই ‘স্বস্তির’ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির পদক্ষেপ কি না এ আলোচনা যেমন উঠেছে; তেমনি চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসে সরকার ‘শুদ্ধ’ হওয়ার চেষ্টা করছে কি না, তা নিয়েও আলোচনা আছে। কারণ ‘দুর্নীতির পাশাপাশি গণতন্ত্রের অবনতিতে সাবেক সেনাপ্রধানের জড়িত থাকার অভিযোগ’ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে আজিজ আহমেদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি সুধী সমাজের মধ্যেও আলোচনা আছে। নির্বাচনের আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর ‘গত ৪৭ বছরে এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখিনি’ এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি আলোচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে যে প্রক্রিয়া রয়েছে তার ওপর মানুষের বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন’ এমনটি উল্লেখ রয়েছে। এও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের দুর্নীতি করেছেন আজিজ আহমেদ।
এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল-জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশের পরও আলোচিত হন তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। ওই রিপোর্টে ক্ষমতার অপব্যবহার ও কিছু দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে। তিনি তার ভাইকে বাংলাদেশের অপরাধের জবাবদিহি থেকে বাঁচাতে সহযোগিতা করেছেন, এমন অভিযোগও করা হয় নিষেধাজ্ঞাসংবলিত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে।
যদিও পরবর্তীকালে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে এক সাক্ষাৎকারে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন আজিজ আহমেদ। ২০২১ সালের ২৪ জুন তিনি অবসরে যান। তবে গুরুতর দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২১ মে আজিজের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণায় এখন আবারও তাকে নিয়ে জোর আলোচনা ও গুঞ্জন চলছে।
এই নিষেধাজ্ঞা এবং বেনজীরকে দুদকের তলব ঘটনায় সৃষ্ট বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংসদ সদস্য আনার খুনের ঘটনা। এ ছাড়া গত ২১ মে ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত এক প্রামাণ্যচিত্রের কারণেও সরকারের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। যদিও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের প্রতিবাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ওই তথ্যচিত্র একপেশে ও উদ্দেশ্যমূলক বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও এক সপ্তাহ ধরেই এই তিন ঘটনা নিয়ে রাজনীতির মাঠে সোচ্চার হয়েছে বিএনপিসহ মাঠের প্রায় সবগুলো বিরোধী দল। বেনজীর ও আজিজকে অপরাধী বানাল কারা, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
প্রায় একই সুরে বক্তব্য নিয়ে সরব হয়েছেন দেশের সুধী সমাজের অনেকেও। তারা বলছেন, আজিজ এবং বেনজীরের দুর্নীতি ও কর্মকাণ্ডের দায় সরকারেরও রয়েছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এক নিবন্ধে লিখেছেন, আজিজের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার দায় অনেকাংশে সরকারের। এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার সোনা চোরাচালানসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে। ফলে তার মতো একজন নেতা আওয়ামী লীগের মতো বড় একটি দলের তিন-তিনবার মনোনয়ন কীভাবে পেলেন এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বর্তমানে নির্বাচিত ৮০ শতাংশ এমপিই চোরাকারবারে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। আর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, নিহত আনোয়ারুল আজীম এমপি তার এলাকায় মাফিয়া হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে ওবায়দুল কাদেরের মতো ব্যক্তিরা প্রশ্রয় দেন বলেই তিনি নিজেকে এমপি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন- এমন মন্তব্য করেন রিজভী।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিরাজনীতিকীকরণ, দুর্বৃত্তায়ন ও টাকা দিয়ে মনোনয়ন-বাণিজ্যের যে রাজনীতির চর্চা, আনারের ঘটনা তারই ফসল। এর চেয়ে ভালো কিছু আমরা আশা করতে পারি না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্য এমপি আনার, জেনারেল আজিজ এবং বেনজীর; কারোরই সরাসরি পক্ষ নেননি। তিনি বলেছেন, আনারের জনপ্রিয়তা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি অপকর্মে জড়িত কি না তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
কোনো অপরাধী শাস্তি ছাড়া পার পাবে না জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে এখন তদন্ত হচ্ছে এবং আরও তদন্ত হবে এ কথা দুদক সূত্রে জানা গেছে। তদন্ত হচ্ছে মানে মামলা হলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
‘যিনি সেনাবাহিনীর প্রধান, তিনিও যদি অপরাধী হোন, তার বিরুদ্ধেও তদন্ত করতে দুদকের কোনো বাধা নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করতে পারবে। অপরাধী হলে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হবে। সে যে-ই হোক’, বলেন ওবায়দুল কাদের।