![ঈমান কি বাড়ে বা কমে?](uploads/2023/11/20/1700468202.23-ok.jpg)
ঈমান অস্পৃশ্য বিষয়। একে পরিমাপ করা যায় না। তাহলে পরিমাপ অযোগ্য এ বিষয়টি বাড়ে বা কমে কীভাবে? এ বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট ইমাম ও ইসলামি স্কলারদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-সহ তার অনুসারীদের বক্তব্য হলো, ‘মূল ঈমান বাড়ে বা কমে না। ঈমানের মৌলিক স্তরে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটার কোনো সুযোগ নেই।’ এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, ‘যেসব বিষয়ের ওপর ঈমান আনা আবশ্যক সেসব বিষয়াদির বিবেচনায় আসমান ও জমিনবাসীর ঈমান বাড়েও না, কমেও না। তবে ঈমানের দৃঢ়তা এবং গভীরতার বিবেচনায় ঈমান বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে। ঈমান ও তাওহিদের বিবেচনায় সব মুমিনের অবস্থান সমান। তবে কর্ম বা আমলের বিবেচনায় মুমিনের অবস্থানে তারতম্য থাকতে বা হতে পারে।’ (আল-ফিকহুল আকবর, ইমাম আবু হানিফা, পৃষ্ঠা: ৫৫)
ইমাম আবু জাফর তহাবি (রহ.) বলেছেন, ‘ঈমান একটি একক বিষয়। মূল ঈমানের ক্ষেত্রে সব মুমিনের স্তর বা অবস্থান অভিন্ন। তবে আল্লাহর ভয়, পরহেজগারী বা তাকওয়া, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণসহ সর্বাবস্থায় উত্তম পথ অনুসরণের মাধ্যমে মুমিনের মাঝে মর্যাদা বা স্তরগত তারতম্য ঘটে।’ (আকিদাতুত তাহাবিয়্যাহ, ইমাম আবু জাফর তহাবি, পৃষ্ঠা : ৪২)
যেসব বিষয়ে ঈমান আনা অপরিহার্য; ঈমানের ছয় বা সাত রোকনসহ, এগুলোর ওপর সবার সমভাবে ঈমান আনা জরুরি। এখানে কারও জন্য কোনো কম-বেশি করার সুযোগ নেই। তবে সবার সাক্ষ্য বা বিশ্বাসের মান, দৃঢ়তা ও গভীরতা সমান হবে না। ফলে ঈমানের মূল বিষয়ে সব মানুষের অবস্থান বা স্তর সমান হলেও ঈমানের শক্তি, সামর্থ্য ও নুরের ক্ষেত্রে সবার অবস্থান বা স্তর সমান নয়। নবী-রাসুলদের ঈমানের ধারে কাছেও সাধারণ মানুষের ঈমান পৌঁছাতে পারবে না। ইবাদত, আনুগত্য ও তাকওয়ার ভিত্তিতে মুমিনের মর্যাদাগত অবস্থান বাড়ে বা কমে। (আকিদাতুত তাহাবিয়্যাহ, ইমাম আবু জাফর তহাবি, অনুবাদ: মীযান হারুন, রাহনুমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা: ৫০০)
সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামাদের (ইমাম আশয়ারি, ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আওজায়ি, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, সুফিয়ান ইবনে উমাইয়া, ফুজাইল ইবনে ইয়াজ, হাফস ইবনে গিয়াস, ওয়াকি, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, ইয়াজিদ ইবনে হারুন, আব্দুর রহমান ইবনে শাওকি, আবু উবায়দা ইবনে কাসিম, হুমাইদি, ইমাম শাফি, ইসহাক ইবনে রাহাওয়াই প্রমুখ) মতে, ঈমান বাড়ে-কমে। ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। (বাইহাকি, সুনানে কুবরা, ২০৯৫০)
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়; তখন যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে তারাই মুমিন। আর যখন তাদের সামনে আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়; তখন তা তাদের ঈমানে বৃদ্ধি ঘটায় এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে (তারাই মুমিন)।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে; তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৭৫১০; মুসলিম, হাদিস: ১৯৩)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, ‘ঈমানের কিছু অংশ অপর কিছু অংশ থেকে উত্তম। সেটি বাড়ে এবং কমে। আমলের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং আমল ছেড়ে দিলে ঈমানের হ্রাস ঘটে। (আস-সুন্নাহ, খল্লাল, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৫৮১)
ইমাম আওজায়ি (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ঈমান কি বাড়ে-কমে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ বাড়ে, এমনকি তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। আবার কমেও, এমনকি তার যৎসামান্যই অবশিষ্ট থাকে। (শরহু উসুলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাতি, লালকাই, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৩৫৪)
ইমাম বুখারি (রহ.) বলেছেন, ‘আমি বিভিন্ন শহরে সহস্রাধিক আলেমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। ঈমান হলো কথা ও কর্মের নাম এবং তা বাড়ে ও কমে—এ বিষয়ে কাউকে মতপার্থক্য করতে দেখিনি।’ (ফাতহুল বারি, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪৭)
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে উলামাদের মতপার্থক্যটি মৌলিক কোনো মতপার্থক্য নয়। শাব্দিক ও অভিব্যক্তিগত পার্থক্য। ইমাম রাজি (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে মোল্লা আলি কারি (রহ.) একে শাব্দিক মতপার্থক্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। (শরহু ফিকহিল আকবর, মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা : ২৫৭-২৫৮; ইলাউস সুন্নাহ, ১৯/২৩৫)
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.) এ বিষয়ে বলেছেন, ‘উভয় পক্ষের বক্তব্যই নিজ নিজ অবস্থানে সঠিক। ইখতিলাফ (বিতর্ক) পাগল মানুষরা দুই দলকে দুই প্রান্তে নিয়ে হাজির করে এবং বিভেদ ঘটায়। (ফয়জুল বারি, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৩৮)
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলেম-উলামাদের মাঝে মতপার্থক্য বিদ্যমান, তবে এটাকে কোনোভাবেই মতবিরোধ বলা যাবে না। যারা বলেন, ঈমানের ক্ষেত্রে কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের উদ্দেশ্য হলো, মুতলাকুল ঈমান বা ন্যূনতম অথবা আবশ্যক ঈমানের ক্ষেত্রে কোনো কম-বেশি নেই। এক্ষেত্রে সব মুমিনের অবস্থান সমান। আর যারা বলেন, ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, কামালুল ঈমান বা ঈমানের পূর্ণতা, দৃঢ়তা ও নুর-শক্তিতে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি ব্যভিচার করে, তখন সে আর মুমিন থাকে না। (বুখারি, হাদিস: ২৩৪৩)
এই হাদিসে ঈমান দ্বারা কামালুল ঈমান বা ঈমানের পূর্ণতা, দৃঢ়তা বা নুর-শক্তি উদ্দেশ্য। মুতলাকুল ঈমান বা ন্যূনতম অথবা আবশ্যক ঈমান উদ্দেশ্য নয়। (উসুলুল ঈমান, ড. আহমদ আলী, গার্ডিয়ান, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪০)
লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক