![স্বাবলম্বী নারীশক্তিতে বলীয়ান অর্থনীতি](uploads/2024/03/08/1709876313.Womens_Day_Workers.jpg)
গত দুই দশকে দেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। শ্রমবাজারে নারী দাপটের সঙ্গে তার অবস্থান জানান দিয়েছেন। সামান্য পুঁজি নিয়েও অনেক নারী সাহস করে ব্যবসায় নেমে আজ সফল। নিজে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, অন্যের আয়ের পথও করে দিয়েছেন। বড় বড় পদে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। বিমান চালাচ্ছেন। দেশ ছেড়ে আরেক দেশে যাচ্ছেন সভা, সেমিনার, শিক্ষকতা করতে। করপোরেট হাউস, সাংবাদিকতা, প্রশাসন কোথায় নেই নারী! ইট ভাঙছেন, দোকান চালাচ্ছেন। রপ্তানি আয়েও বড় ভূমিকা নারীর। পোশাকশিল্পের ৬৫-৭০ শতাংশ নারী শ্রমিক।
কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইসিটিসহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারীর আয় তার নিজের জীবন বদলে দিয়েছে, তার পরিবারকে ভালো রেখেছে। দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তবে নারীরা জানিয়েছেন, নারীর চলার পথ এখনো মসৃণ না। প্রতিবন্ধকতা কমলেও একেবারে দূর হয়নি। বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়েই নারীকে কাজ করতে হচ্ছে।
ব্যবসায়িক সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক এবং ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, একসময়ে কাঁথা সেলাই, হাঁস-মুরগি পালন, ডিম বিক্রি, বাড়ির আনাচেকানাচে শাকসবজি লাগানো, বাড়িতে সেলাই মেশিন কিনে কাপড় বানানোর মতো সহজ কাজ করে নারী আয় করেছেন। অন্যদিকে শিক্ষিত নারীর চাকরি স্কুল-কলেজের শিক্ষকতায় সীমাবদ্ধ ছিল। সে দিন আর নেই। এখন নারীরা চ্যালেঞ্জ নিয়েই ব্যবসা করছেন, কঠোর পরিশ্রমের চাকরি করছেন। প্রতিষ্ঠানের বড় পদে কাজ করছেন। দেশের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় নিজের বানানো পণ্য বিক্রি করতে ছুটছেন।
শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এবং বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সত্তরের দশকের মধ্যভাগে ১০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে নারীর (১০ বছরের ওপরের বয়সের) হার ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। আশির দশকে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের এ হিসাব ছিল ৮ শতাংশ। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। এ হার বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়। নব্বইয়ের দশকের শেষে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ২৩ শতাংশ হয়। ২০১০ সালে এ হার বেড়ে ৩৬ শতাংশে পৌঁছায়। বর্তমানে এ হার আরও বেড়ে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, পুঁজিসংকটে এখনো অনেক নারী পরিকল্পনা করেও ব্যবসা শুরু করতে পারেন না, অনেকে ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারছেন না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অজুহাতে নারী উদ্যাক্তাদের ঋণ দেয় না। চাকরিতেও আছে নারীর প্রতি বৈষম্য। একই বা বেশি কাজ করেও পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় বেতন কম পাচ্ছেন। অনেকে পরিবার থেকেই সহযোগিতা পান না। তার পরও অর্থনীতিতে নারীর অবদান বেড়েছে। বিশেষভাবে ব্যবসায়ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে’ শীর্ষক জরিপে বলা হয়েছে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ের বার্ষিক মূল্য সংযোজন ৩ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেড় দশক আগেও পুরুষেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এ ব্যবসায়। নারীদের অংশগ্রহণ ছিল দেড় শতাংশেরও নিচে। তবে এ পরিসংখ্যান পাল্টেছে। গত দেড় দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ৮২৯ শতাংশ। বড় মাপের নারী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারাও।
২০২০ সালের দিকে অনলাইন ব্যবসায় শিক্ষিত নারীরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে লক্ষাধিক অনলাইন ব্যবসা রয়েছে। এসব ব্যবসার অর্ধেকের বেশি মালিক নারীরা। এসব ব্যবসার বেশির ভাগই করোনার সময়ে শুরু হয়েছে। এসব নারী উদ্যোক্তা মাসে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা বা তার বেশি আয় করছেন।
২০১৭ সাল থেকেই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ লাখ। ই-কমার্সভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের বর্তমান সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, সুযোগ-সুবিধা ও পরিবারের প্রয়োজনে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই উদ্যোক্তা হচ্ছেন নারী। ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য নারীরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছেন। প্রথমত, ডেলিভারি সিস্টেম ও পরিবহন সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে নারীদের। গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে এ দুটি ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে আরও বেশি নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা আরও সাশ্রয়ী ও ভোক্তাবান্ধব করা প্রয়োজন।
উচ্চপদে নারীর সংখ্যা বাড়লেও এখনো পুরুষের তুলনায় কম। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের তথ্যানুসারে, মোট পরিচালক পদে মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নারী কর্মরত। পেশাজীবী পদে এ হার ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। নীতিপ্রণেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ নারী আছেন। গত পাঁচ বছরে এসব কাজে নারীর প্রতিনিধিত্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে বলেও গবেষণায় বলা হয়েছে।
এখন নারীরা অনেক সাহসী। তারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও কাজে যাচ্ছেন। প্রবাসী নারীদের পাঠানো অর্থ তাদের পরিবারকে ভালো রাখছে। দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) প্রতিবেদন বলছে, এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে চাকরি নিয়ে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮৮ জন।
সিডিপির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান গড়ে শীর্ষ দশেই থাকে। এ অবস্থানে নিয়ে যেতে দেশের নারী শ্রমিকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রতিবছর এই নারীরা সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাচ্ছেন। এসব নারীকে নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্ব নিতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলে প্রবাসে নারী কর্মী যাওয়ার হার বাড়বে।
আমাদের দেশের কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। কৃষি তথ্য সার্ভিস এবং শ্রমশক্তি জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, দেশের মোট কর্মজীবী নারীর ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত।
বিআইডিএসের ‘কৃষিতে নারী’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামে চাষ, আবাদ-পরবর্তী কাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা, দুধ আহরণ, বাড়ির ভেতরে সবজি বাগান এবং বীজ সংরক্ষণের মতো জরুরি কাজগুলোর বেশির ভাগই নারী করেন। এ ছাড়া জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার দেওয়া, কীটনাশক দেওয়া, বীজ তৈরি, শস্য জমি থেকে বাড়িতে নেওয়া, ফসল ভাঙানো, বাছাই ও প্যাকেটজাত করার কাজেও নারীরা অংশ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান কতটা, তার গণনা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে না। কারণ নারী উল্লেখযোগ্য সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করেন, যার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি বা অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয় না। রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, শিশু ও বয়স্কদের যত্ন, সন্তানের পড়ালেখায় সাহায্য, রান্নার জন্য জ্বালানি কিংবা পানি আনা ইত্যাদি কাজ শ্রমবাজারের কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেও পরিগণিত হয় না এবং জাতীয় আয়ের হিসাবেও আসে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অমূল্যায়িত ও অস্বীকৃত গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারীরা ঘরের সব কাজ করেন, অথচ সেই কাজ কারও নজরে আসে না, সেই কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। এসব কাজের মূল্য নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী একজন নারী যিনি কর্মজীবী নন, তিনি গৃহস্থালির কাজে প্রতিদিন গড়ে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা ব্যয় করেন। অন্যদিকে একজন কর্মজীবী নারী গৃহস্থালির কাজে ব্যয় করেন গড়ে ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। অর্থাৎ নারীরা তাদের এ শ্রমঘণ্টায় যেসব কাজ করেন, সেসব কাজের মূল্যমান হিসাব করা হয় না এবং এসব কাজ, যা কি না প্রাথমিকভাবে নারীই করেন, তার অবদানও অস্বীকৃত থেকে যায়।
সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন গবেষণায় দেখিয়েছে, ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা সেখানে ১ শতাংশের কম। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে যোগ করা গেলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। নারীর এ অপ্রদর্শিত গৃহস্থালি কাজের বার্ষিক আর্থিক মূল্য গড় জাতীয় আয়ের ৩৯ দশমিক ৫২ শতাংশের সমপরিমাণ। অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারীর এই অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজকে যদি পরিমাপ করা হতো, তবে তা হতো বাংলাদেশের জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমান।