মার্কিন মুলুকে ফুটবলের নতুন জাগরণ। নেপথ্যে লিওনেল মেসি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর উপস্থিতিতে সৌদি ফুটবলে যোগ হলো ভিন্নমাত্রা। পিএসজি ছেড়ে নেইমারও যখন মরুর বুকে, তখন ইউরোপিয়ান ফুটবল হারাল ত্রিরত্ন (মেসি, রোনালদো, নেইমার)। ক্লাব ফুটবলে ঐতিহাসিক ট্রেবল জিতে ম্যানচেস্টার সিটি নাম লেখাল ইতিহাসে। মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’অর থেকে শুরু করে ধর্ষণের অভিযোগে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার দানি আলভেসের গ্রেপ্তার কাণ্ড থেকে শুরু করে আরও কত কী ঘটেছে ২০২৩ সালে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এই বছরে আন্তর্জাতিক ফুটবলের ফিরিস্তি জানাচ্ছেন মাহমুদুন্নবী চঞ্চল।
মার্কিন মুলুকে মেসি কাঁপন
সৌদি ক্লাব আল হিলালে যাচ্ছেন লিওনেল মেসি। এ বছরের শুরু থেকে এমন গুঞ্জন ছিল বেশ। তবে সব হিসেব ভুল প্রমাণ করে পিএসজি ছেড়ে ফুটবলের এই খুদে জাদুকর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামিতে। গত জুলাইয়ে বেকহ্যামের ক্লাবটিতে মেসির পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মার্কিন মুলুকে নতুন এক জাগরণ। পয়েন্ট তালিকায় তলানিতে থাকা দলকে এক নিমিষেই গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলেন মেসি। শুধু তাই নয়, করে যান গোলের পর গোল। বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতিতে মেসির তনুমন ছিল বেশ সতেজ, সঙ্গে নতুন ক্লাবের বাড়তি রোমাঞ্চ। সব মিলিয়ে বার্সা সতীর্থ সার্জিও বুসকেটস ও জর্ডি অ্যালবাদের নিয়ে গড়া মায়ামি ক্লাবকে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন মেসি। এনে দেন কয়েকটি শিরোপাও। মেসির আগমনে গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শুরু হয় নতুন ফুটবল উন্মাদনা, যা এখনো বিদ্যমান।
সৌদি ফুটবলে জাগরণ
২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ চলাকালীন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে গিয়েছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। ইউরোপের পাট চুকিয়ে সিআরসেভেন চলে যান সৌদি প্রো-ক্লাব আল নাসরে। পর্তুগিজ এই ফুটবলারের স্পর্শে নতুন মাত্রা পায় সৌদি ফুটবল। যে দেশটির লিগ একটা পর্যায়ে ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে, এখন তা অনেকটাই সপ্রতিভ। সেটা রোনালদোর কারণে। শুধু রোনালদো নয়, মরুর বুকে ফুটবল জাগরণে সব চেষ্টাই করেছে সৌদি সরকার। পেট্রো ডলারের ঝনঝনানিতে ইউরোপের অনেক তারকা ফুটবলারকেই কিনে নেয় তারা। রোনালদোর পর উল্লেখযোগ্য নাম নেইমার। পিএসজি থেকে ব্রাজিলিয়ান এই সুপারস্টার নাম লেখান আল-হিলালে। যে ক্লাবে রেকর্ড অর্থে যাওয়ার কথা ছিল মেসিরও। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে সৌদি প্রো-লিগের আরেক দল আল ইত্তিহাদে নাম লিখিয়েছেন ফরাসি স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা। এ ছাড়া সাদিও মানেসহ ইউরোপের অন্তত ৫০ জন খেলোয়াড়কে দেখা যাচ্ছে সৌদি ফুটবল মাতাতে। এক বছর আগেও যেখানে সৌদি ফুটবল ছিল অনেকটা আড়ালে, ২০২৩-এ সেখানে সৃষ্টি হয় জাগরণ।
ম্যানসিটির পঞ্চক
২০২৩ সালটি ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির জন্য ছিল ঐতিহাসিক। মৌসুমে তারা পাঁচ পাঁচটি শিরোপা জিতে। প্রথমবারের মতো জিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। ইউরোপের দশম দল হিসেবে অর্জন করে ট্রেবল আর ইংলিশ ক্লাব হিসেবে দ্বিতীয় (আগেরটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের)। গত বছর ম্যানসিটি প্রথম জেতে এফএ কাপের শিরোপা। যেটি ছিল ম্যানচেস্টার ডার্বিও। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ম্যানইউকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে ম্যানসিটি। এরপর আসে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। ৩৮ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৮৯ পয়েন্ট ছিল সিটির। দুই শিরোপা জয়ের পর ম্যানসিটির চোখ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপার দিকে। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলান। ১-০ গোলে জিতে যায় হলান্ড, ফিল ফোডেন, কেভিন ডি ব্রুইনেররা। ২০০৮ সালে আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের মালিকানাধীন আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ সিটি কিনে নেওয়ার পর এই লক্ষ্যই ধার্য করা হয়েছিল, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ইউরোপসেরা হতে হবে। সে লক্ষ্য পেপ গার্দিওলা পূরুণ করেছেন এ বছর। শুধু তাই নয়, প্রথমবারের মতো এক মৌসুমে পাঁচটি শিরোপাও ঘরে তোলে সিটিজেনরা। ট্রেবলের পাশাপাশি দলটি জেতে উয়েফা সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা।
মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’অর
বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক হিসেবে এবারের ব্যালন ডি’অর জিততে চলেছেন মেসি, তা ছিল অনুমেয়। তার ব্যতিক্রম হয়নি। ম্যানসিটির আর্লিং হলান্ডকে টপকে রেকর্ড অষ্টম ব্যালন ডি’অর করায়ত্ত করেন ফুটবলের এই খুদে জাদুকর। ইউরোপের বাইরে খেলা প্রথম ফুটবলার হিসেবে মেসি জেতেন এই পুরস্কার। ২০০৭ থেকে ২০২২, ব্যালন ডি’অর ‘বৈশ্বিক’ হয়ে ওঠার এই ১৫ বছরে যে পাঁচ ফুটবলার জিতেছেন, তারা সবাই ইউরোপে খেলেছেন। মেসি নিজেও আছেন এ তালিকায়। আগের সাত ব্যালন ডি’অর তিনি জিতেছিলেন বার্সেলোনা ও পিএসজির খেলোয়াড় হিসেবে। তার দীর্ঘ সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ব্যালন ডি’অর জিতেছেন পাঁচবার
বব চার্লটনের প্রয়াণ
গত ২১ অক্টোবর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার স্যার ববি চার্লটন। ৮৬ বছর বয়সী চার্লটনের মৃত্যুর কারণ জানা যায় এর ১১ দিন পর। দ্য উইলোস কেয়ার হোমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন চার্লটন। আঘাত সহ্য করতে না পেরেই মৃত্যু হয়েছিল তার। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল চার্লটনের। মাঝমাঠে খেললেও ইংল্যান্ডের হয়ে ১০৬টি ম্যাচে ৪৯টি গোল করেছিলেন চার্লটন। খেলোয়াড়ি জীবনের বেশির ভাগ সময় ম্যানইউয়ে খেলেছেন। রেডডেভিলসদের হয়ে ৭৫৮টি ম্যাচে করেছেন ২৪৯টি গোল। পাস এবং দূরপাল্লার শটের কারণে বিখ্যাত ছিলেন চার্লটন। তার জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা ১৯৫৮ সালে মিউনিখের বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা। ম্যানইউয়ের প্রথম দলের আটজন ফুটবলার এবং অনেক সাপোর্ট স্টাফ মারা গিয়েছিলেন সেই ঘটনায়। অক্ষত ছিলেন স্যার ববি।
মারাকানা কাণ্ড
২০২৬ বিশ্বকাপ দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইয়ে মারাকানা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। তবে ম্যাচ শুরুর আগে গ্যালারিতে দাঙা বেধে যায়। এতে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ মিনিট দেরিতে শুরু হয় ম্যাচ। মারাকানায় গ্যালারির এক অংশে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বেধড়ক পেটায় ব্রাজিলের পুলিশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, জাতীয় সংগীত বাজার সময় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। পুলিশ আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা পুলিশের ওপর গ্যালারির চেয়ার ছুড়ে মারেন। এমন পরিস্থিতিতে আর্জেন্টিনা দল অধিনায়ক লিওনেল মেসির নেতৃত্বে মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর মাঠে ফেরেন মেসিরা। । আলোচিত এই ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারায় মেসির আর্জেন্টিনা। এই ঘটনায় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলকে তিরস্কার করে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা।
স্পেনের মেয়েদের বিশ্বকাপ জয় ও চুমু কাণ্ড
নারী ফুটবল বিশ্বকাপে এ বছরটা ছিল স্পেনের মেয়েদের। সিডনিতে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে স্প্যানিশ সুন্দরীরা। তবে শিরোপা উদযাপনের মঞ্চে জন্ম নেয় বিতর্ক। স্পেনের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা জেনি হেরমোসো মঞ্চে উঠে নিজের পদক সংগ্রহ করে এগিয়ে যান স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট লুইস রুবিয়ালেসের দিকে। এ সময় অপ্রত্যাশিতভাবে এবং সম্মতি ছাড়াই হেরমোসোর ঠোঁটে চুমু দেন রুবিয়ালেস। যে চুমু আর শুধু চুমু হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই ঘটনার পর ফুটবল বিশ্বে রীতিমতো ঝড় ওঠে। দাবি জানানো হয় রুবিয়ালসের পদত্যাগের। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমা চান রুবিয়ালস। তবে কয়েক মাস ধরে চলা এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ান স্প্যানিশ ফুটবল কর্মকর্তা।
নরক যন্ত্রণায় আলভেস
এ বছরটা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল দানি আলভেসের জন্য নরক যন্ত্রণার। সামনে অপেক্ষা করছে হয়তো কঠিন শাস্তি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বার্সেলোনার একটি নৈশ ক্লাবে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় আলভেসকে। গত জানুয়ারি থেকে তিনি আছেন কারাগারে। বিচারের জন্য আগামী ফেব্রুয়ারির ৫ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। মামলায় জামিন পাননি বার্সেলোনার হয়ে ৪৫টি শিরোপা জেতা এই রাইট ব্যাক। স্পেনের আদালত তার জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তখন থেকেই বার্সেলোনার কারাগারে আছেন আলভেস।
স্পেনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাইটক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে ছিলেন ওই নারী। ওই নারীর অভিযোগ, আলভেস তাকে চড় মারেন এবং নাইটক্লাবের বাথরুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন। শুরুতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন আলভেস। পরে গত এপ্রিলে সাক্ষ্য পরিবর্তন করেন তিনি। স্বীকার করে নেন অভিযোগকারী নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের কথা। তবে দুজনের সম্মতিতে তা হয়েছিল বলে দাবি করেন আলভেস। আলভেসের ৯ বছরের জেল চেয়েছেন স্পেনের এক প্রসিকিউটর। স্পেনে ধর্ষণের কোনো ঘটনা প্রথমে তদন্ত হয় সাধারণ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ হিসেবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর আলভেসের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে তখনকার ক্লাব পুমাস। বার্সেলোনা, জুভেন্টাস ও পিএসজির মতো ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলা এই ডিফেন্ডারের সঙ্গে পরে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার স্ত্রী জোয়ানা সানস। ব্রাজিলের হয়ে আলভেস খেলেছেন ১২৬ ম্যাচ। গত বছরের ডিসেম্বরে কাতার বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচে ব্রাজিলের অধিনায়কত্বও করেন তিনি।