![খেলতে না পারার কষ্ট খেলোয়াড়দের](uploads/2024/01/14/1705219306.Hockey.jpg)
‘হকি খেলোয়াড় আমরা অলস হয়ে যাচ্ছি। খেলা নেই। কি যে দুর্বিষহ দিন কাটছে আমাদের।’ দেশের একজন শীর্ষ হকি তারকা অবলীলায় বলে যান এ কথাগুলো। শুধু একজন নয়, হকি খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের কণ্ঠেই এমন হাহাকারের সুর বাজছে এখন। কোনো রাখঢাক না রেখে অনেকেই নিজেদের দুরবস্থার কথা খুলে বলছেন। কেউ কেউ আবার চক্ষুলজ্জায় কিছু বলছেন না। তবে একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে, খেলার জন্য তারা প্রত্যেকেই ব্যাকুল।
দেশের শীর্ষ হকি খেলোয়াড়দের রুটি-রুজির অন্যতম বড় মাধ্যম হলো প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু ঘরোয়া হকির শীর্ষ এই প্রতিযোগিতা মাঠে গড়ায়নি গত দুই বছর। সবশেষ লিগ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের নভেম্বরে। সেই লিগের আগেও ছিল ৩ বছরের দীর্ঘ বিরতি। ২০১৬ সাল থেকে ২০২৩, এই ৮ বছরে প্রিমিয়ার হকির মাত্র ৩টি আসর মাঠে গড়িয়েছে। আগেও যে চিত্রটা স্বাস্থ্যকর ছিল, তা নয়। ১৯৯৮ সালে প্রিমিয়ার লিগ যুগে প্রবেশ করে হকি। এরপর ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু লিগ হয়েছে মাত্র ১৩টি! এই সময়ে প্রথম বিভাগ হকি লিগ হয়েছে ১২টি। দ্বিতীয় বিভাগ লিগ আরও অনিয়মিত।
অথচ একসময় ক্রিকেটের বিস্তারের আগে ফুটবলের পরই উচ্চারিত হতো হকির নাম। ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর ক্রম অনুসারে হকি তৃতীয় স্থান নেয়। কিন্তু ক্রিকেটার ও ফুটবলাররা যেখানে প্রতিবছর খেলার মধ্যে থাকেন, হকি খেলোয়াড়রা সেখানে বসে বসে দিন পার করছেন। এভাবে হকির কত যে প্রতিভার অপচয় হয়েছে! ক্রিকেটার আফিফ হোসেন ধ্রুব কিংবা আকবর আলীর কথাই উল্লেখ করা যাক। বিকেএসপিতে বেড়ে ওঠা এই দুজনই তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে পারছেন। এরই মধ্যে সাফল্য ভাস্বরও হয়েছেন। কিন্তু আফিফেরই বন্ধু হকির আশরাফুল ইসলাম কিংবা আকবরের বন্ধু আরশাদ হোসেনদের ভাগ্যটা বিপরীত। দুজনই নিজেদের প্রতিভার জানান দিয়েছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আসরে। কিন্তু ক্যারিয়ার নিয়ে তারা বড় কোনো স্বপ্ন দেখার সাহস পান না। অনিশ্চয়তায় ঠাসা তাদের এ জীবন। জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় পুস্কর খীসা মিমো তাই বলেন, ‘খেলা মাঠে না থাকলে আমাদের যে কী কষ্টটা হয়, তা বলে বোঝাতে পারব না। হকি খেলে আসলে ক্যারিয়ার গড়া যায় না। কিন্তু হকি রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, তাই খেলে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, হকি না খেলে অন্য খেলা বেছে নিলেই ভালো হতো।’
আশরাফুল নিজেদের চিত্র তুলে ধরেন বলেন, ‘এই যে খেলা ঠিকঠাক হয় না, এ নিয়ে মানুষের অনেক কথার উত্তর দিতে হয়। বাড়ি গেলে অনেকে অনেক ধরনের কথা বলেন। আমরা কিছু খেলোয়াড় তবু বিভিন্ন বাহিনীতে আছি। কিন্তু যারা কোনো বাহিনীতে নেই, তারা তো সব সময় বাসাতেই থাকেন। ওদের তো আরও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে আমাকে বলেন, বাইরে গেলে মানুষ ওদের জিজ্ঞেস করেন, দল থেকে বাদ পড়ে গেছেন নাকি? এগুলো শুনতে সত্যিই লজ্জা লাগে। ওদের অবস্থা আসলে খুবই খারাপ। অন্য কিছু করে ওদের জীবিকানির্বাহ করতে হচ্ছে।’
২০২২ সালের শেষের দিকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু খেলোয়াড়দের অভিযোগ এত দিন পেরিয়ে গেলেও পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকাই নাকি বাকি তাদের। সিনিয়র খেলোয়াড় ইমরান হাসান পিন্টু তাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘একটা কথা আছে না, কপালে সুখ সয় না। আমাদের হকি খেলোয়াড়দের অবস্থা ঠিক তাই। একটা ভালো কিছু হলেই তারপর আর কিছু থাকে না।’
উত্তরসূরিদের এমন চিত্র খুব পীড়া দেয় হকির সাবেক তারকাদের। রফিকুল ইসলাম কামাল তো বলেই ফেললেন, ‘সত্যি বলতে হকিতে যে অবস্থা চলছে, এভাবে চললে আগামীতে আমার মনে হয় না খেলাটিকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। কারণ বছরের পর বছর যদি খেলা না হয়, লিগ না হয়, তাহলে মনে হয় না হকি খেলার প্রতি আগ্রহ কেউ পাবে।’ কামাল জানান, তার ২০ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি লিগ পেয়েছেন মাত্র ৮-৯টা। এখনো সেই একই রকম চিত্র। এটা খুবই হতাশাজনক। লিগ নিয়মিত না হওয়ার পেছনে কামাল শুধু ফেডারেশনকে দায়ী করছেন না, ক্লাবগুলোর অর্থনৈতিক সমস্যাও কারণ হিসেবে উল্লখ করে তিনি বলেন, ‘কারণ লিগ না হওয়ার পেছনে ফেডারেশনের সেভাবে কোনো ভূমিকা নেই। ক্লাবগুলো অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে খেলতে চায় না। সেই বিষয়গুলোতে তাদের সাপোর্ট করা গেলে হয়তো প্রতিবছর লিগ করা যেত।’
খেলোয়াড়দের এই হতাশার বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক সাঈদের সঙ্গে। ক্লাবগুলোর লিগ খেলায় অনীহা প্রসঙ্গে মমিনুল হক সাঈদ বলেন, ‘আমাদের ক্লাবগুলো রাষ্ট্রীয় কোনো অনুদান পায় না। আগে যেসব সোশ্যাল ওয়ার্কাররা সামাজিক সেবার কারণে ক্লাবগুলোতে ডোনেশন করতেন, সেই শ্রেণির লোকগুলো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে ক্লাবগুলোকে এখন ডোনেশন করেন না। এখন জীবনযাত্রার যে মান, টিকে থাকার জন্য দল গড়তেও ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন। সবাই এ কারণেই কিছু গড়িমসি করে।’ এ সময় ফেডারেশনের আর্থিক দুরবস্থার কথাও তুলে ধরেন তিনি, ‘ফেডারেশনই যেমন অনেকটা হাত পেতে চলে। আমরা একটি জাতীয় ফেডারেশন। আমরা বার্ষিক ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাই। বিদ্যুৎ বিল ও পানির জন্য প্রায় ৬ লাখ টাকা কেটে রাখে। আমরা হাতেই পাই ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু বছরে স্টাফ সেলারি প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এই স্টাফ সেলারিতেই আমাদের ভর্তুকি দিতে হয়। অনেক সময় আমরা নিজের পকেট থেকে দিয়ে থাকি। আনুষঙ্গিক আরও অনেক খরচ তো থাকেই। আমরাও পারি না তাদের (ক্লাবগুলোর) পাশে দাঁড়াতে। এই বাধ্যবাধকতা বা ব্যারিকেডগুলো যে রয়েছে, এখান থেকে আমরা বেরুতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় দেড় শর মতো দেশ হকিতে অংশগ্রহণ করছে, সেখানে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ত্রিশের মধ্যে থেকেও আমরা দেশে হকির বিস্তার ঘটাতে পারছি না। আন্তর্জাতিকভাবেও সাফল্য নিয়ে আসতে পারছি না। কারণ এই ব্যারিকেডগুলো। এই অর্থনৈতিক মুক্তি যদি না ঘটে, তা হলে আমাদের পক্ষে আসলেই কিছু করা সম্ভব না। আমরা অনেকেই মুখস্থ বুলি বলতে পারব, অনেকেই স্বপ্ন দেখাতে পারব। কিন্তু স্বপ্ন দেখাতে যেসব জিনিস প্রয়োজন, সেগুলোর সঠিক সমন্বয় যদি না হয়, তাহলে গল্প গল্পই থেকে যাবে।’