‘এটাই আমার শেষ নির্বাচন’! ঘুরে ফিরে এ কথা বলে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন সুনামগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অন্যদিকে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে দলটির প্রার্থী বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের জীবনে প্রথম নির্বাচন। তার কথায়ও শুরুর সূত্রপাত। তিনি বলছেন, ‘নির্বাচন আমার জন্য একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাস করলেই হবে আমার শুরু।’
মান্নানের ‘শেষ’ আর সাদিকের ‘শুরু’! ভোটের মাঠে শেষ ও শুরু বলাটা বেশ রেখাপাত করছে দুটো আসনের ভোটারদের মনে। সুনামগঞ্জের দুটো আসন ঘুরে মানুষের মুখে ‘শুরু’ আর ‘শেষ’ নিয়ে নানা অঙ্ক কষতে শোনা গেছে। জাঁদরেল আমলা থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় মান্নান-সাদিককে নিয়ে ভোটে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে চলছে ভোট-পরবর্তী হিসাব-নিকাশ। সরকারের উন্নয়ন-অভিযাত্রার সঙ্গে তারাও অভিষিক্ত হচ্ছেন নানা অভিধায়। আগামী মন্ত্রিসভায় সুনামগঞ্জ থেকে মান্নান না সাদিক- এ আলোচনায় চলছে অঙ্ক কষা।
সুনামগঞ্জ বাংলাদেশের একটি প্রান্তিক জেলা। সংসদীয় আসন পাঁচটি। সব কটি আসনে নৌকা, লাঙ্গল, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র, বিএনএম, তৃণমূল বিএনপিসহ মোট ৩০ জন প্রার্থী এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শেষ সময়ে এসে প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক, সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে। ভোটারদের কাছে নিজের যোগ্যতা যাচাইয়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে ভোটার ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের চোখ সুনামগঞ্জ-৩ (শান্তিগঞ্জ-জগন্নাথপুর) এবং সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর দিকে। এই দুই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সরকারের গুরুদায়িত্বে থাকা এম এ মান্নান-মোহাম্মদ সাদিক।
শান্তিগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৩ নির্বাচনি এলাকা। ভোটের রাজনীতিতে প্রয়াত জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের আসন হিসেবে পরিচিত এটি। তার মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে উপনির্বাচনে প্রথম ভোট করে হেরে যান তখনকার সময়ে স্রেফ সাবেক সচিব পরিচয়ের এম এ মান্নান। এরপর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তিনি বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
এ দায়িত্বকালে জীবনের পঞ্চম নির্বাচন করছেন মান্নান। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে বিজয়ী তৎকালীন চারদলীয় জোটের প্রার্থী ও বর্তমানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী শাহীনুর পাশা চৌধুরী।
এবারের নির্বাচনকে জীবনের ‘শেষ’ নির্বাচন ঘোষণা দিয়ে শেষবারের মতো ভোট চাইছেন এম এ মান্নান। তিনি আবারও নির্বাচিত হয়ে তার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার কথা বলছেন। ভোটের প্রচারে মান্নান বলছেন, ‘আমার বয়স হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে অসুখ-বিসুখেও ধরে। এটাই আমার শেষ নির্বাচন। তাই বিশেষ বিবেচনা করবেন। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন। এবার আবার মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করব।’
নিজেকে কৃষকের সন্তান উল্লেখ করে তিনি আরও বলছেন, ‘আমি কৃষকের সন্তান, গ্রামে আমার জন্ম। আর দেশের ৮০ ভাগ ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। আমার মূল লক্ষ্য হলো গ্রামে বসবাস করা মানুষের জন্য কাজ করা। আমাকে আবারও ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে আমার বাকি অসমাপ্ত কাজগুলো করব।’
জেলা শহর, শহরতলি ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৪ আসন। দশম জাতীয় নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এখানকার এমপি। তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় হুইপ। এ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকা ছিল দীর্ঘ। এর মধ্যে কোনো তালিকায় না থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হন ড. মোহাম্মদ সাদিক। তার প্রার্থিতায় দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেও জেলার হেভিওয়েট অনেক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাহার কর নেন।
ভোটাররা বলছেন, জেলা সদরের আসনে আওয়ামী লীগনের সুদীর্ঘ প্রার্থী তালিকা বলে দিচ্ছিল সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা। নানা গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত। এর মধ্যে কেন্দ্র থেকে মনোনীত দলীয় প্রার্থী মোহাম্মদ সাদিককে ঘিরে দৃশ্যত ঐক্য গড়ে উঠেছে।
বিজয়ী হলে তার ‘ঘরের দরজা, মনের দরজা’ সব সময় সবার জন্য খোলা থাকবে জানিয়ে সাদিক আরও বলেন, ‘যদি কথায় আর কাজে মিল না আসে তাহলে আপনারা আমরা পথ আটকাবেন। আমাকে থামাবেন, আমাকে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করাবেন। প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা এই দেশের উন্নয়ন। আমার এলাকার মানুষ যদি আমাকে চান, নির্বাচিত করেন, তাহলে সেই উন্নয়নের সারথী হয়ে আপনাদের একজন কর্মী হয়ে কাজ করে যাব। আমি নেতা হতে চাই না, আমি আপনাদের কর্মী হয়ে পাশে থাকতে চাই।’
মোহাম্মদ সাদিকের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরতলির ধারাগাঁও। এম এ মান্নানের বাড়ি শান্তিগঞ্জের ডুংরিয়া। দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস বেশি। দুটো নির্বাচনি এলাকার মধ্যবর্তী স্থান দিরাই-মদনপুর সড়ক মোড়ের টি-স্টলে গত শুক্রবার বিকেলে ওই গ্রামের দুই ভোটারকে ঘিরে চলছিল ভোটের আড্ডা। তাদের কথার বিষয়বস্তু এমন, সচিব পদ থেকে অবসর জীবনে থেকে একটানা তিনবার এমপি, দুই মেয়াদে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করে সুন্দর এক সমাপ্তির পথে হাঁটছেন এখন এম এ মান্নান। তার শেষ থেকে আরেক শুরুর সূত্রপাত মোহাম্মদ সাদিক। এবার জিতলে নিশ্চিত মন্ত্রী দুজন না, একজনই হবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবেন?