![উদ্যোগের অভাব, সংকটে পর্যটন](uploads/2023/12/27/1703664554.Habiganj-Tourism.jpg)
প্রকৃতির রম্য নিকেতন বৃহত্তর সিলেটের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ। হাওর-পাহাড়-অরণ্যে ঘেরা এই জেলাকে প্রকৃতি সাজিয়েছে অকৃপণভাবে। এখানে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা, লক্ষ্মীবাউর জলাবন, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত তেলিয়াপাড়া স্মৃতিস্তম্ভ, সবুজ চা বাগানে গালিছা বিছানো উঁচু-নিচু টিলা আর মনোরম রাবার বাগান। রয়েছে বর্ষায় বিস্তীর্ণ হাওরের মনভোলানো রূপ, কমলাবতীর সাগরদিঘি, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, মোঘল আমলের স্থাপত্য উচাইল শাহী মসজিদ, ৭০০ বছরের বিথঙ্গল আখড়াসহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সেই সঙ্গে রয়েছে খাসিয়া, টিপরা এবং মণিপুরী আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ। ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করার মতো এতসব দর্শনীয় স্থান থাকার পরও শুধু সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ছাড়া জেলার অন্য কোনো স্থানে পর্যটকের খুব একটা দেখা মেলে না।
জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত এই উদ্যানে রয়েছে প্রায় ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তু। এর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি এবং সমপরিমাণ গাছপালা। বিলুপ্তপ্রায় পাখি, জীবজন্তু আর গাছপালার সমারোহ এই উদ্যানে।
উদ্যানের অভ্যন্তরভাগে টিপরাপাড়ায় একটি পাহাড়ি আদিবাসীর ২৪টি পরিবার বসবাস করে। উদ্যানের কাছাকাছি আছে ৯টি চা বাগান। এই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রতি বছর সমাগম ঘটে কয়েক লাখ দর্শনার্থীর। তবে উদ্যানের ভেতরে নানা অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ রয়েছে দর্শনার্থীদের। সেই সঙ্গে উদ্যানের কাছাকাছি রাত কাটানোর মতো কোনো হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট না থাকায় দূর-দূরান্তের পর্যটকদের পড়তে হয় বিপাকে। যে কারণে এই উদ্যানটিও কাঙ্ক্ষিত পর্যটক টানতে পারছে না। একই উপজেলায় রয়েছে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পর দেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি এটি। এর আয়তন ১৭৯৫ দশমিক ৫৪ হেক্টর। এই বনে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং সাত প্রজাতির উভচর রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা।
চুনারুঘাট শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসীমান্তঘেঁষা এই বনে যেতে হলে প্রায় ৬ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা রয়েছে। এ কারণে একমাত্র মোটরসাইকেল ছাড়া বনের ভেতরে যাতায়াত সম্ভব নয়। বৃষ্টি হলে মোটরসাইকেল দিয়েও যাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ হবে এ বনাঞ্চলটি।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাপনা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সাতছড়ি এবং রেমা কালেঙ্গাকে ঘিরে বড় ধরনের পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। কিন্তু শুধু উদ্যোগ এবং প্রচারের অভাবে সেটিকে আমরা তুলে ধরতে পারছি না। বিশেষ করে বনের চারপাশে শুধু চা বাগান। আইন অনুযায়ী চা বাগানে কোনো স্থাপনা গড়ে তোলা যায় না। যে কারণে কোনো হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি পর্যটন নিয়ে প্রচার বাড়ায় এবং স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে আইনি জটিলতা রয়েছে, সেখানে সহযোগিতা করে, তাহলে বেসরকারি পর্যায়েও অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবেন।’
প্রবীণ সাংবাদিক, আইনজীবী ও পরিবেশকর্মী মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল বলেন, ‘মূলত অরণ্য, পাহাড়, হাওর এবং ঐতিহাসিক আর প্রাচীন স্থাপত্য, সবকিছু একসঙ্গে দেখার অন্যতম জেলা হবিগঞ্জ। ধরা যাক, বানিয়াচং উপজেলার কথা। এই উপজেলায় রয়েছে আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ জলাবন লক্ষ্মীবাউর। স্থানীয়ভাবে এটি খরতির জঙ্গল হিসেবে পরিচিত। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুকুর ‘কমলাবতীর সাগরদিঘি’, ৭০০ বছরের পুরনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বিথঙ্গল আখড়া, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, প্রথম ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে।’ তিনি বলেন, ‘এসব দর্শনীয় স্থানের কথা এখনো মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। মানুষকে জানাতে হবে হবিগঞ্জে এগুলো আছে। পাশাপাশি প্রতিটি দর্শনীয় স্থানকে পর্যটকবান্ধব করে তুলতে হবে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাহলে প্রতি বছর লাখ লাখ দর্শনার্থীর পা পড়বে এ জেলায়।’
চুনারুঘাটে খাসিয়া, টিপরা এবং মণিপুরী আদিবাসী সম্প্রদায়ের গ্রাম রয়েছে। এই আদিবাসীদের গ্রামগুলোকে ঘিরে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমেরও সম্ভাবনা রয়েছে এই জেলায়।’
ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা দর্শনীয় স্থানগুলোকে ঢেলে সাজালে শুধু দেশি নয়, বিদেশি পর্যটকের চোখ আটকাবে এ জেলায়। আর এই পর্যটনকে ঘিরে প্রতি বছর অন্তত কয়েক শ কোটি টাকার ব্যবসা সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান হবে কয়েক হাজার মানুষের।
হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্টির সভাপতি মিজানুর রহমান শামীম বলেন, ‘হবিগঞ্জের পর্যটনকে উন্নত করতে হলে প্রথমে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার এখানে কয়েক শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যদি পর্যটন স্পটগুলোকে ঢেলে সাজায়, তাহলে বেশি-বিদেশি পর্যটক আসবে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা হবিগঞ্জের পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে চান। কিন্তু পর্যটনের অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকে বিনিয়োগ করতে ভয় পান।’
এ বিষয়ে বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ‘করোনার কারণে পর্যটন খাতে তেমন উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে সারা দেশের পর্যটন নিয়ে বড় একটি মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে। যেখানে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। এই মাস্টার প্ল্যানে হবিগঞ্জকেও রাখা আছে। নির্বাচনের পরই এর কাজ শুরু হবে।’