![পোশাকশিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কা](uploads/2024/07/03/Garment-Khaborer-kagoj-1719977337.jpg)
কারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অর্থনৈতিক অঞ্চল বা শিল্প এলাকার বাইরে নতুন করে কারখানা স্থাপন করা যাবে না। যদি কেউ এই নির্দেশ না মেনে পোশাকসহ অন্যান্য কারখানা স্থাপন করা হয় তাহলে উক্ত শিল্পে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। এমনকি ঋণও মিলবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক মালিকরা বলেছেন, আমাদের দেশের শিল্পাঞ্চলগুলো এখনো তৈরি না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। বরং এই সিদ্ধান্তের ফলে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান দুটোই পিছিয়ে যাবে। এ ছাড়া নতুন করে ছোট ছোট উদ্যোক্তাও তৈরি হবে না। কারণ, হুট করেই শিল্পাঞ্চলে জায়গা নিয়ে কারখানা প্রতিষ্ঠা করা তাদের জন্য সম্ভব হবে না। এ ছাড়া যারা ইতোমধ্যেই নতুন শিল্পকারখানার বেশির ভাগ কাজ শেষ করেছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তাদের বিনিয়োগের ফল কী হবে? এসব কারণে এই সিদ্ধান্তকে অপরিণামদর্শী আখ্যা দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। সেই সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে, কারখানাগুলোকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুযোগ দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ইপিজেডের বাইরে নতুন শিল্প স্থাপন করা হলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। পরিবেশের উন্নয়ন এবং ভূমি ও জ্বালানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে সরকার কেবল নির্দিষ্ট এলাকায় শিল্প স্থাপন করতে চায় বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক শোভন ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘অবশ্যই বিচ্ছিন্নভাবে শিল্পকারখানাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকুক সেটা আমরাও চাই না। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত। আমরাও চাই এগুলো সংশোধন হোক। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের তো একটা সময় দিতে হবে। আমাদের মিরসরাই অর্থনৈতিক প্রস্তুত না। আমাদের যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর কাজ তেমন এগোয়নি।
আমরা মনে করি, মিরসরাই প্রস্তুত হতে এখনো পাঁচ বছর সময় লাগবে। পোশাক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে এখন অনেক লোক ইতোমধ্যে জমি কিনে যে ভবন তুলে ফেলেছে, তাহলে তারা এখন কোথায় যাবে? আবার ঋণ পেতে যেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ছাড়পত্র- সেটা পেতে গেলে হয়রানি আরও বাড়বে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আদেশকে আমরা প্রত্যাহার করে নিতে বলেছি। শোভন ইসলাম আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু পোশাকশিল্পই নয় বরং আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাকের অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে রপ্তানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরেই এটিকে ৫০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এই পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক খাতের রপ্তানি আয়কে প্রায় দ্বিগুণ করে ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পোশাক খাতে রয়েছে বিপুল কর্মসংস্থান। বড়, মাঝারি ও ছোট- সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পোশাক কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। আবার নারীদের আত্মনির্ভরশীলতায় একটা বড় অবদান রাখছে খাতটি। কারণ এই খাতের মোট শ্রমিকের প্রায় ৬২ শতাংশই নারী।
বর্তমানে ভূরাজনৈতিক সংকট এবং এর প্রভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে সৃষ্ট অস্থিরতায় পোশাকশিল্প এক সন্ধিক্ষণ পার করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে নতুন এই নির্দেশনা পোশাক খাতের সংকটকে আরও তীব্র করার পাশাপাশি শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে বলেও মনে করছেন পোশাক কারখানার মালিকরা। সেই সঙ্গে উদ্যোক্তারা নতুন কারখানা গড়ে তুলতে নিরুৎসাহিত হবেন বলেও মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, ‘আমরা শিল্পাঞ্চলে যেতে চাই। কিন্তু শিল্পাঞ্চলকে প্রস্তুত না করে, সেখানে যাওয়ার জন্য কড়াকাড়ি আরোপ কার্যত পোশাকশিল্পকে গলা চেপে ধরা ছাড়া আর কিছুই না। এটা করা হলে শিল্পায়ন ব্যাহত হবে।
টিএডি গ্রুপের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘সরকার চাচ্ছে শিল্পটাকে একটা কেন্দ্রীয়করণ করতে। আমরা সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু দেশের ১০০টা শিল্পাঞ্চলের মধ্যে ১৫টার মতো প্রস্তুত। ধরুন আমি যদি বলি কালকে আমি যাব, তাহলে সরকার কিন্তু আমাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে না। তাহলে কি আমরা শিল্পায়ন করব না। এ রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের শিল্পায়নের কণ্ঠরোধ করা ছাড়া আর কিছুই না।’
বিজিএমইএর পরিচালক মো. রেজাউল আলম (মিরু) বলেন, আমরা সরকারকে জানিয়েছি, এটা করলে আমাদের দেশে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, আমাদের দেশ এখনো ওই জায়গায় যেতে পারেনি। এই ছোট ছোট শিল্প থেকেই বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। ছোট কারখানাগুলো একটু একটু করে বিনিয়োগ বাড়ায়। একপর্যায়ে তারা চাইলেই ইপিজেড বা শিল্পাঞ্চলে কারখানা করতে পারে। যদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় তাহলে আমাদের দেশে ছোট উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডিসিপ্লিন ওয়েতে’ কারখানা করার জন্য এই দুটি সিদ্ধান্ত আমি মনে করি সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমার অর্থনৈতিক অঞ্চল কী প্রস্তুত আছে। আমার শিল্পকারখানা শুরু করার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, সেগুলো দেওয়ার জন্য তারা কি প্রস্তুত? আমাকে যদি ওখানে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনে বাধ্য করা হয়, আমি তো সেটা করতে পারব না। এ কারণে, এই সিদ্ধান্ত তখনই কার্যকর হওয়া উচিত যখন, সেখানে যাওয়ার জন্য সবকিছু প্রস্তুত হবে। তখনই কেবল এই ধরনের সিদ্ধান্ত সঠিক হতে পারে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ভালো, সেটা আমরা বলতেই পারি। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। বরং এই সিদ্ধান্তের ফলে শিল্পায়নটা পিছিয়ে যাবে এবং কর্মসংস্থানও ব্যাহত হবে।