ঢাকা ২১ আষাঢ় ১৪৩১, শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক গুরুত্ব

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৮ এএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৮ এএম
প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক গুরুত্ব
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ভারত সফরের দুই সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের বিষয়টি আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সঙ্গেও উন্নয়ন অভিযাত্রায় অংশীদার হিসেবে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকতে চায় চীন। 

পরিস্থিতিগত কারণে আঞ্চলিক উদীয়মান দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের কড়া নজর রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে দেশ দুটি। এটিকে কাজে লাগানোর কৌশল নিয়ে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি অনুসরণ করেই টানা চার মেয়াদে এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। 

আর এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর ও আসন্ন চীন সফর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এমন অবস্থাকে দৃশ্যত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একধরনের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মাইলফলক হিসেবে লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বন্ধুত্ব স্থাপনের রোল মডেল হিসেবেও বিষয়টিকে তুলে ধরা যায়।

বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশে প্রভাব বিস্তারের একধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে ভারত ও চীনের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল ও জোরদার করার প্রচেষ্টা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক একীভূতকরণে বিশেষ অবদান রাখবে।

আমরা লক্ষ করেছি যে, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত ও চীনের সঙ্গে এমন চমৎকার ‘ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক’ বজায় রেখে চলেছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক। 

প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ভারত বাংলাদেশের বিপদের বন্ধু আর চীন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারসাম্যের কূটনীতি স্পষ্ট। তিনি ভারত এবং চীন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান এবং সেই নীতি অনুসরণ করেই চলেছেন এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সমাধানের জন্য চীনের কোনো বিকল্প নেই বলেও বাংলাদেশ মনে করছে। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। তাই ভারসাম্যের কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দূরদর্শিতার স্পষ্ট ছাপ রাখবে বলা যায়। 

অন্যদিকে চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক নির্ভরতায় যুক্তরাষ্ট্র এই সফরের দিকে তাকিয়ে থাকবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এই অঞ্চলে এখন চীনের একাধিপত্য প্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো দেশগুলো চীনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দৃষ্টি থাকাটাই স্বাভাবিক। 

নানাবিধ বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক বিষয়ের সঙ্গে আঞ্চলিক-রাজনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশরূপে পরিগণিত। ফলে বৃহৎ পরাশক্তির রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে নতুন করে সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। 

ভারত চায় ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকুক। চীনের প্রত্যাশাও বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকবে। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এটি সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা পালন অতি তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত ১৫ বছরের অধিক সময় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপম নেতৃত্বে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বরাজনীতি-আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় উচ্চাসনে সমাসীন। 

বাংলাদেশ আজ একটি উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বনেতাদের কাছেও বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির হার-শিল্প উন্নয়নসহ সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ, রাজনৈতিক পরিপক্বতা সর্বোপরি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ অধিকমাত্রায় সমাদৃত। কৌশলগত কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবদান অপরিসীম। 

ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখ্যা, সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। যার ৫৮ শতাংশই তরুণ। কর্মশক্তি ও ভোক্তা- এই দুই হিসাবেই সংখ্যাটা অনেক। এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ। 

জিডিপির পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্বের যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে। সমতল ভূমির ক্ষেত্রে যেটা ২৫ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিক পরাশক্তিদের দৃষ্টি এই অঞ্চলে নিবদ্ধ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত ও উন্নয়নে অংশীদার চীনসহ সবার সঙ্গে নিবিড় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতিতে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে। 

ভূ-রাজনীতিতে যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান আঞ্চলিক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম সারথি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আর এ কারণেই ভারত সফরের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চলেছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের চাহিদার ক্ষেত্রগুলোতে ভারত বেশ মনোযোগী। বাংলাদেশও এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক যত বেশি ভারসাম্যমূলক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিমুখী হবে, তত বেশি আমাদের দেশের জনগণের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। 

তাই কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায়ের মাধ্যমে ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার হাতকে আরও মসৃণ করবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফর দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীল রাজনীতিতে শক্তিশালী ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করবে। 

পরিশেষে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের অভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা হলো দেশের উন্নয়নকে যেমন এগিয়ে নেওয়া, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভারসাম্য নীতি প্রতিষ্ঠিত করা।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

ভারতীয় রাজনীতিতে রাহুল গান্ধীর অপরিহার্যতা

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২৫ এএম
আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২৫ এএম
ভারতীয় রাজনীতিতে রাহুল গান্ধীর অপরিহার্যতা
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের প্রথা অনুযায়ী নির্বাচনোত্তর রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে লোকসভা অধিবেশন। কিন্তু সংখ্যায় দুই কক্ষ এখন অচল। লোকসভার বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী এবং রাজ্যসভার নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। উভয় কক্ষে দুই নেতা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনের সময় দেশের NEET (ডাক্তারিতে ভর্তির সর্বভারতীয় পরীক্ষা) এবং NET (কলেজে চাকরি ও গবেষণার সর্বভারতীয় পরীক্ষা) প্রশ্নপত্র কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে বাজারে ফাঁস হয়ে গেছে। ফলে লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে।

নরেন্দ্র মোদির শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান প্রশ্নপত্র কালোবাজারে বিক্রির কথা স্বীকার করে যথা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। গোটা ভারত এখন এ নিয়ে তোলপাড়। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা কাগজপত্র দেখিয়ে অভিযোগ করেছেন, মোদির গত ১০ বছর শাসনকালে ৭০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়ে কালোবাজারে বিক্রি হয়েছে।

সোমবার লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিরোধীরা এসব তথ্য ধরে সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। গোটা দেশে এত বড় দুর্নীতি নিয়ে এর আগে কোনো কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসেনি। এই প্রথম ভারতবর্ষের লোকসভা দেখল আরএসএস-বিজেপি গত ১০ বছরে দেশকে কোন দিকে নিয়ে গেছে।

নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবতরা আবার হিন্দুত্ববাদের স্লোগান দিয়ে আসরে নেমে পড়েছেন। এর উত্তর দিতে গিয়ে রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন, চাষিদের জমি কেড়ে নিয়ে অযোধ্যায় বিমানবন্দর বানানো হয়েছে। সে জন্য অযোধ্যার বিজেপি প্রার্থী সমাজবাদী প্রার্থীর হাতে বিপুলভাবে পরাজিত হয়েছেন।

রাহুল যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন তাকে বাধা দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, আপনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। রাহুল তাকে বলেন, আমাদের সংবিধানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন সবার সমান অধিকার। কয়েক দিন ধরে সংসদে রাহুলের বক্তব্য দেখে এবং শুনে বিজেপি এমপিরা একই সুরে কুৎসিত ভাষায় জওহরলাল নেহরুকে আক্রমণ করে চলেছেন। 

দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৬৪ সালের ২৭ মে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নেহরু। তার পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর তাসখন্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর জয়ী হয়ে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি করেছিলেন, তখন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, দিল্লির এক মহিলার হাতে আমেরিকার বিদেশনীতি পরাজিত হয়েছে। আমরা ওই মহিলাকে উচিত শাস্তি দেব। এমনকি ঠিক যুদ্ধের আবহে ইন্দিরা গান্ধী ছুটে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে। হাতজোড় করে তিনি নিক্সনকে বলেছিলেন, বাঙালিদের হত্যা করার জন্য আপনি পাকিস্তানের হাতে অস্ত্র দেবেন না। 

নিক্সন সেই অনুরোধের কোনো জবাব দেননি। এসব তো ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, নিক্সন-চীন যৌথভাবে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর দিল্লিতে শিখদের দাঙ্গা হয়েছিল। দিল্লির ওই দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছিল আরএসএস। তাই আরএসএসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে সোমবার রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী দৃঢ়তার সঙ্গে বলে দেন, যতই আপনারা চেষ্টা করুন, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করতে দেবে না দেশের মানুষই।

বারবার বিরোধী দলনেতাকে বাধা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, আমরা একদিন হিন্দু রাষ্ট্র করবই। সরকার ও ট্রেজারি বেঞ্চের বাগবিতণ্ডার মধ্যে লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেন, ’২৪-এর নির্বাচনে তো চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। আর কোনো দিন পারবেন না। 

সারা জীবন স্বাধীনতার সংগ্রাম করে, জেল খেটে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। কিছু না পেলে আপনারা এখন তাকে ঠেলে গালমন্দ করছেন। এটা কোন দেশের গণতন্ত্র। মনে রাখবেন, আপনারা সংখ্যালঘু সরকার। বিজেপিকে এবার দেশের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি। আপনারা এজেন্সি দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। দেশ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীও আপনারা ভেঙে দিয়েছেন। আরএসএস ক্যাডার দিয়ে অগ্নিবীর সেনা তৈরি করেছেন।

গত ১০ বছরে পাঁচটি কংগ্রেসশাসিত সরকার ভেঙে দিয়েছে বিজেপি। দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা নিয়ে গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্রেণির বিশেষজ্ঞরা সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখছেন। টেলিভিশনেও বক্তব্য রাখছেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদির স্লোগান ছিল কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারমুক্ত ভারত। মোদির মুখের ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রাহুল আজ বলেছেন, পারলে করে দেখান। 

দ্রব্যমূল্য, বেকার সমস্যা এবং দেশের মানুষের সমস্যা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনারা হিন্দুত্ববাদের কথা তুলছেন। আর আমরাও বলছি, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখছি এবং রাখব। রাহুল যখনই সংসদে বক্তৃতা করছেন, তখনই মাঝে মাঝে মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ করা হলে স্পিকার বলছেন, আমার হাতে কোনো সুইচ নেই। আমরা বন্ধ করছি না। অথচ যারা টিভি দেখছেন, তারাও বিষয়টি লক্ষ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সংসদীয় রাজনীতি শুরু হওয়ার সময় থেকেই বিরোধী দল ছায়া মন্ত্রিসভা করছে আজ পর্যন্ত। 

নেহরু, অটল বিহারি রাজপেয়ি, রাজীব গান্ধী, নরসিহা রাও যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিরোধীদের ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের নীতি নিয়ম মেনে চলেছেন। রাহুল চাইছেন সেই ধাঁচে এবারও ছায়া মন্ত্রিসভা তৈরি করবেন। কিন্তু মোদি, অমিত শাহ কি এই ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেবেন? এই প্রশ্নে এখন সংসদ এলাকা তোলপাড়। ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ী ছায়া মন্ত্রিসভা করতে দিতে বাধ্য সরকারপক্ষ।

রাহুলের জোটের অন্যতম শরিক সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব বলেছেন, আইন অনুযায়ী ছায়া মন্ত্রিসভা করতে দিতে বাধ্য, তা দেওয়া না হলে আমরা সংসদ অচল করে দেব। ভারতের সংসদীয় রাজনীতি আগামী কয়েক মাস কোন পথে যাবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চুলচেরা বিচার করছেন। এদিকে আরএসএস মুখপাত্ররা বলছেন, আমরা ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেব না।
 

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২২ এএম
আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২২ এএম
‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল প্রসঙ্গে
মো. শাহ্‌ আলম

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা তিনটি দাবি নিয়ে মোট ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের দাবিগুলো হলো: ১. প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, ২. সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি ও ৩. শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একমাত্র দাবি হলো প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এতদিন তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব দাবির প্রতি সরকারের অবহেলা এবং শিক্ষকদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কারণে তারা এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা আন্দোলনে নেমেছেন।

২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট প্রবাসী, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা- এই চারটি প্রকল্প নিয়ে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প যাত্রা শুরু করে। পরে সব স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে একটি নতুন স্কিম চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৩ মার্চ প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। 

স্কিমটি প্রত্যাহারের দাবিতে বেশ কিছু কর্মসূচি পালনের পর গত ৪ জুন প্রথম অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। এর পরও দাবির বিষয়ে সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত সপ্তাহে টানা তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। একই দাবিতে গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেও শিক্ষকনেতারা জোরালো বক্তব্য দেন। ১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দেন তারা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক 
শিক্ষা কার্যক্রম।

গত ২০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে জানানো হয়, ২০২৪ সালের ১ জুলাই বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নতুন যোগদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় আসবেন। 

‘প্রত্যয়’ স্কিমে অংশ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হবে এবং প্রতিষ্ঠানও সমপরিমাণ অর্থ দেবে। এই অর্থ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করা হবে এবং পেনশন ফান্ড গঠিত হবে। ১৭ আগস্ট ২০২৩ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন, প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা স্কিম চালু। ১৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে এসআরও নম্বর ৪৭-আইন/২০২৪-এর মাধ্যমে ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রণয়ন।

‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ 

১. কর রেয়াত: মাসিক জমার বিপরীতে কর রেয়াত ও পেনশন আয়করমুক্ত।

২. নমিনির পেনশন: ৭৫ বছরের আগে পেনশনারের মৃত্যু হলে নমিনি অবশিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত মাসিক পেনশন পাবেন।

৩. মাসিক চাঁদা: কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের মাসিক চাঁদা পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে।

৪. ইএফটি (EFT): পেনশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেনশনারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে।

৫. মৃত্যুকালীন ফেরত: পেনশনযোগ্য বয়সের আগে মৃত্যু হলে জমাকৃত অর্থ নমিনি বা নমিনিদের এককালীন ফেরত।

৬. বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ: ১ জুলাই ২০২৪ থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ।

৭. বর্তমান কর্মচারীর অংশগ্রহণ: ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ১০ বছরের বেশি চাকরির মেয়াদ থাকা বর্তমান কর্মচারীদের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ।

৮. চাঁদার পরিমাণ: মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা কর্তন ও সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদান।

৯. আজীবন পেনশন: পেনশনার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন।

‘প্রত্যয়’ স্কিমের আওতায় রয়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, আইডিআরএ, আইসিবি, সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক, সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বিমা করপোরেশনসহ সব করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, ইপিবি, বিএসটিআইসহ প্রায় ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। পদ্মা অয়েল, যমুনা অয়েলসহ সরকারের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা থাকা কোম্পানিগুলোর নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আর বিদ্যমান নিয়মে পেনশন পাবেন না।

‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে সংশয়

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই নিয়মে পেনশন প্রাপ্য হলেও তাদের সেই সুবিধা থেকে বের করে ‘প্রত্যয়’ স্কিমে যুক্ত করাকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ষড়যন্ত্র মনে করা হচ্ছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অনেকেই বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা স্কিম এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ অন্যদের জন্য আলাদা কেন হবে? এতদিন তো একই ধারায় চলে আসছিল, তাহলে এখন হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এই আলাদা স্কিমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘ষড়যন্ত্র’ মনে করছেন। অশান্ত হলে সরকারবিরোধীদের জন্য সুযোগ তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

২০১৫ সালে শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক পে-স্কেল কার্যকর করার পর এবার ‘প্রত্যয়’ নামক আরেকটি বৈষম্যমূলক পেনশনব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন পেনশনব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং শিক্ষকদের সুবিধা কমিয়ে দেয়। 

এই পেনশনব্যবস্থা শুধু আর্থিক দিক থেকে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও বৈষম্যমূলক। কারণ, একই স্কেলে একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন নিয়ে শিক্ষকদের আলাদাভাবে পেনশন দেওয়া উচিত নয়। বরং শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত সংস্থায় যারা ১ জুলাই থেকে নতুন চাকরিতে যোগ দেবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ‘প্রত্যয়’ পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে। এসব সংস্থার নতুন চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর প্রচলিত পদ্ধতিতে পেনশন পাবেন না। এই নিয়মের সঙ্গে একমত হতে না পেরে শিক্ষকরা কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন। 

তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী গত সোমবার থেকে শিক্ষকরা কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন এবং সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। কারণ, এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, এই নিয়মের ফলে ভালো শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগের ফলে আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই স্কিমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘বৈষম্যমূলক’ বলে উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবি করেছেন।

অভিভাবকদের শিক্ষকদের কাছ থেকে আকাশসম প্রত্যাশা থাকে এবং একজন আদর্শ শিক্ষক তার সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেন। আদর্শ শিক্ষক মানবসৃষ্টির শৈল্পিক কারিগর, যার দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। তার মান, মর্যাদা ও সম্মান সর্বব্যাপী এবং সবার শীর্ষে থাকার কথা। উল্টো তাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে আপনি কীভাবে আশা করছেন আপনার সন্তান সঠিকভাবে মানুষ হবে। আজকে কী কারণে জাতি গড়ার কারিগররা রাস্তায় মিটিং-মিছিল করছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার জন্য এটি লজ্জার ও অপমানের। 

তাই বলব, শিক্ষকরা আমাদের সমাজ ও জাতির মূল স্তম্ভ, তাদের সঠিক মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। শিক্ষকরা যে ধোয়া তুলসী পাতা, তা দাবি করছি না। আমাদের ভুল থাকলে রাষ্ট্রের উচিত তা শুধরে নেওয়া, আমাদের রুটি-রুজির ওপর আঘাত করা নয়। 

প্রত্যয় স্কিম নিয়ে অচলাবস্থার সমাধানে কিছু কার্যকর পরামর্শ হতে পারে-

১. সংলাপ ও পরামর্শ সভা: শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে সংলাপ: শিক্ষকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বৈঠক করা উচিত, যাতে তাদের উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা সরাসরি শোনা ও সমাধান করা যায়।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ: পেনশন এবং আর্থিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিক্ষকদের জন্য একটি সুষম ও ন্যায্য স্কিম প্রণয়ন করা উচিত।

২. সমন্বিত পেনশনব্যবস্থা: মিশ্র পেনশনব্যবস্থা: শিক্ষকদের জন্য একটি মিশ্র পেনশনব্যবস্থা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা সরকারি কর্মকর্তাদের মতোই সুবিধা দেয় এবং একই সঙ্গে প্রত্যয় স্কিমের কিছু ইতিবাচক দিকও অন্তর্ভুক্ত করে।
স্বতন্ত্র পেনশন স্কিম: শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি পেনশন স্কিম তৈরি করা যেতে পারে, যা তাদের কাজের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা প্রদান করে।

৩. প্রয়োজনীয় সমন্বয়: নিয়ম ও শর্তাবলি পর্যালোচনা: শিক্ষকদের জন্য প্রণীত পেনশন স্কিমের নিয়ম ও শর্তাবলি পর্যালোচনা করে তার মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা উচিত, যাতে তারা সুবিধাবঞ্চিত না হন।
সুবিধা বৃদ্ধি: নতুন পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের জন্য আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করা উচিত।

৪. শিক্ষকদের ভূমিকা ও মর্যাদার স্বীকৃতি: শিক্ষকদের গুরুত্ব: শিক্ষকদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝে তাদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
উৎসাহ ও প্রণোদনা: শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে তারা তাদের পেশায় আরও উৎসাহিত হন।

৫. সময়সূচি নির্ধারণ: সময়সীমা: সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত, যাতে দ্রুত সমাধান সম্ভব হয় এবং শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যেতে পারেন খুব দ্রুত সময়ে।

কার্যকর পর্যবেক্ষণ: প্রক্রিয়ার কার্যকর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করার জন্য একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন নীতি শুধু আর্থিক দিক থেকে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও সমতামূলক হওয়া উচিত। এক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে একই স্কেলে কাজ করা ব্যক্তিদের পেনশন অসম হওয়া অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক। 

বরং শিক্ষকদের বেতন ও পেনশন হতে হবে বিশেষ এবং যথাযথভাবে সম্মানজনক, কারণ তারা সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাদের অবদানের যথাযোগ্য মূল্যায়ন এবং সম্মান দেওয়া প্রয়োজন, যা প্রাপ্ত পেনশনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের পেনশন পদ্ধতিতে একটি পরিবর্তন আনতে হবে এবং এই পরিবর্তনটি হওয়া উচিত একটি উন্নত এবং আপগ্রেডেড পদ্ধতির মাধ্যমে। যাতে করে শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সমাজে তাদের অবদানের যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়।

সরকার এবং শিক্ষক উভয়ের মধ্যে সঠিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে ‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে অচলাবস্থা সমাধান করা সম্ভব হবে। মনে রাখবেন আগামী প্রজন্মকে সঠিকভাবে যুগোপযোগী মানুষ বানাতে হলে শিক্ষকদের রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে এবং তাদের সুপার গ্রেডে উন্নীত করা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। মনে রাখবেন, মহান জাতি গঠনের কারিগর এই শিক্ষকরা রাষ্ট্রের কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। তার পরও এই শিক্ষকসমাজ কেন বৈষম্যের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে বারবার?
 
লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, আইআইইউএম, মালয়েশিয়া

চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাংলাদেশের সম্ভাবনা

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:০৭ এএম
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:০৭ এএম
চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাংলাদেশের সম্ভাবনা
মুন্সি ফয়েজ আহমদ

বিআরআই হচ্ছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি চীনের একটি উদ্যোগ; যা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ ঘনিষ্ঠ করেছে। এটি এমন একটি ধারণা, যেখানে অসংখ্য বড় ও ক্ষুদ্র প্রকল্পের সমন্বিত চিন্তাভাবনা সামনে চলে আসে। এর অনেকগুলো ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। আরও অসংখ্য নতুন প্রকল্প আগামীতে গ্রহণ করা হবে। এই ধারণাটি চীনের জন্য নতুন বা বিশেষ কিছু নয়। তাদের ভবিষ্যতের ভাবনা ও দৃশ্যকল্পের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিলে যায়। 

কারণ তারা অসংখ্য জাতীয়, দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংযোগে সহযোগিতার মাধ্যমে সবার সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩০টিরও বেশি দেশে তাদের বিআরআই সহযোগিতা বিস্তৃত। এটির উদ্দেশ্য এসব দেশের সঙ্গে মালিকানা, দায়িত্ব, উন্নয়ন ভাগ করে নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া। 

যা-ই হোক, উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে প্রকল্প নির্বাচন, শর্তাবলির বিষয়ে আন্তরিক ও সমতাভিত্তিক আলোচনা, উদ্দেশ্য, সুবিধা এবং সম্ভাব্য বাধাসহ সব বিষয়ের স্বচ্ছতার ওপর। সাফল্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়তা হলো- এই উদ্যোগের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অগ্রগতি, উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রকল্পগুলোকে নিয়মিত পর্যালোচনা ও পরিকল্পিত করার জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিআরআইয়ের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি চীনা মালিকানাধীন উদ্যোগ। কোনো সহযোগিতার উদ্যোগ কখনো একটি দেশের সম্পূর্ণ একক মালিকানাধীন হতে পারে না। যদিও এটি চীনা উদ্যোগ, চীনের সীমান্তের মধ্যে ছাড়া বিআরআইয়ের অন্য সব প্রকল্প একচেটিয়াভাবে চীনের মালিকানাধীন হতে পারে না। 

কোনো প্রকল্প দ্বিপক্ষীয় হলে তা দুই দেশের মালিকানাধীন। যেহেতু অনেক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে, তাই চীন সেগুলোর অংশীদার হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা অনুমান করতে পারি, বিআরআইয়ের অধীনে কিছু প্রকল্প কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বা জাতীয়ভাবে গৃহীত হলে সেই দেশের মালিকানাধীন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই জাতীয় প্রকল্পগুলো দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয়ভাবে অংশীদারির ভিত্তিতে যৌথ মালিকানাধীনও হতে পারে। 

প্রস্তাবক দেশ হিসেবে বিআরআইতে চীনের অনেক স্বার্থ রয়েছে। এটি চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান হাতিয়ার। এটি চীনা বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্য এবং অগ্রাধিকারগুলোর পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় অর্থনীতির গতি বৃদ্ধির জন্য একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করছে। 

প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, উন্নয়নশীল দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিশ্বায়ন বজায় রাখা এবং টেকসই করা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বৃদ্ধি করা চীনের অন্যতম স্বার্থ। বিআরআই চীনকে তার ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ ফান্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহার, উৎপাদন, নির্মাণ এবং অবকাঠামোসহ কৌশলগত সম্পদের চীনা আমদানি ও রপ্তানির জন্য বিকল্প পথ খোলার ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে পারে।  

তবে চীন ছাড়া অন্য দেশও বিআরআই থেকে লাভবান হবে। তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো চীনের মতোই বিভিন্ন সুবিধা পাবে। তুলনামূলকভাবে কম সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশের ক্ষেত্রেও বিআরআইতে অংশগ্রহণ অনেক সুবিধা এনে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় তহবিল/বিনিয়োগ সংগ্রহ, আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত সংযোগসহ নানামুখী সুবিধা। 

সব ক্ষেত্রেই বিআরআই দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে অবকাঠামোর অভাব, বিনিয়োগ তহবিল, আধুনিক প্রযুক্তি, বাজারে প্রবেশের বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। বিষয়গুলো মোকাবিলায় বিআরআই থেকে বাংলাদেশও অন্যান্য তুলনীয় অবস্থানের দেশগুলো অনুরূপ সুবিধা পেতে পারে।

বিআরআই চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। এটি ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপের কিছু দেশ এবং আরও কেউ কেউ আশঙ্কা বা সন্দেহের চোখে দেখে। যদিও অনেকের চীনের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ছড়িয়ে দেওয়া বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে। বিআরআইকে অনেক ক্ষেত্রে  আনুষ্ঠানিকভাবে যেভাবে বর্ণনা করা হয় তা থেকে সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া স্বচ্ছতা ও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যার অভাব রয়েছে।

বিআরআইয়ের সমালোচকরা একে একচেটিয়াভাবে চীনা উদ্যোগ/প্রকল্প হিসেবে দেখেন, যেন একচেটিয়াভাবে চীনা স্বার্থ রক্ষার জন্যই ওই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটি প্রায়শই বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, এ উদ্যোগটিতে অন্য অংশগ্রহণকারীদের চাহিদা এবং আগ্রহকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না। যদিও চীনের বাইরে বিআরআইয়ের অনেক বিরোধিতাকারী রয়েছে, সেই দেশে কিছু চীনা পণ্ডিত, বিনিয়োগকারী, ব্যাংকারও রয়েছেন। 

সেই বিরোধীরা বিনিয়োগের রিটার্ন বা প্রকল্পের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সতর্কতার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া অনেক ভুল ধারণাও রয়েছে। অনেকেই বিআরআইকে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষার লক্ষ্যে পরিচালিত বলে সন্দেহ পোষণ করে। চীনা সহায়তা প্রকল্প থেকে ঋণের ফাঁদে পড়ার ভয়, অলাভজনক প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য অংশীদার দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আপস করার ভয়ও রয়েছে। 

বিআরআই অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অস্থিরতা, সমন্বয়ের অভাব, বিভিন্ন নিয়ম, প্রবিধান এবং পদ্ধতির সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। কেউ কেউ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, সিপিইসি পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলোকে ঋণের ফাঁদ বা সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। 

বাংলাদেশ চারদিকে ভারত ঘেরা। তাই ভারত ও মায়ানমার উভয়েরই বিআরআইতে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের বিআরআই থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার পূর্বশর্ত। এ ছাড়া অনুন্নত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব, দক্ষ জনশক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবেশগত অবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর অবস্থান এবং মায়ানমারের সঙ্গে টানাপোড়েন সম্পর্ক- এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিআরআইতে কার্যকরী অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য অনেক সুবিধা এনে দিতে পারে। 

বিশ্বে এমন কোনো উদ্যোগ নেই, যা চ্যালেঞ্জ বা বাধার সম্মুখীন হয়নি। বিআরআইও এর ব্যতিক্রম নয়। ওপরে উল্লিখিত বিআরআইয়ের চ্যালেঞ্জগুলোর বর্ণনা থেকেই প্রাসঙ্গিক প্রতিকারের ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এমন বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত যা অংশগ্রহণকারীদের কাছে বিশেষ আবেদন রাখবে। অংশগ্রহণকারীদের চাহিদা এবং আগ্রহের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। 

মালিকানা, দায়িত্ব বণ্টন, সুবিধা এবং লাভ-ক্ষতির বিষয়ে স্পষ্ট থাকতে হবে। চীনের উদ্দেশ্য এবং স্বার্থ সম্পর্কে স্বচ্ছতা এবং স্পষ্টতা নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। আন্তরিকভাবে মুক্ত আলোচনা ও পরামর্শের ওপর জোর দিতে হবে। সহযোগিতার পারস্পরিক সুবিধার ওপর নজর দিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয়ভাবে সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। 

প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী দেশের উচিত সুশাসন নিশ্চিতে এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশেষ করে বিআরআই-সম্পর্কিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে বিভিন্ন নিয়ম, প্রবিধান এবং পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করতে হবে। বিআরআই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। 

বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা অংশী দেশের জনগণের মধ্যে বৃহত্তর সংযোগ এবং সহায়তা করেছে। এমন কিছু করতে হবে যা অনুসরণ করার মতো, যা সবার জন্য উপকার বয়ে আনবে। যদি সমতার নীতির ভিত্তিতে যথাযথ পরিশ্রমের সঙ্গে উদ্যেগী হওয়া যায়। তাহলে পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা এবং সুবিধা অনেক বাড়বে। 

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

সত্য যখন বিস্ময় জাগায়

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:০৪ এএম
আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:০৪ এএম
সত্য যখন বিস্ময় জাগায়
রাজেকুজ্জামান রতন

ছাগলকাণ্ড দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর আগে শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তার অবিশ্বাস্য সম্পদ, সেনাপ্রধানের ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে মানুষের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। অনেকে বলেন, আমাদের স্মৃতিশক্তি নাকি খুবই কম। অনেকটা গোল্ডফিশের মতো। অ্যাকুরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতেই ভুলে যায়। আমাদের নতুন ইস্যু এলে পুরোনো ইস্যু ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা প্রচণ্ড। 

অবশ্য এ কারণেই কিছুটা সুস্থ আছি আমরা। তা না হলে রিজেন্ট সাহেদের ‘কারবার’, স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ‘মিঠু চক্রের’ বিপুল দুর্নীতি, ক্যাসিনো সম্রাট খালেদের ক্ষমতা আর সম্পদ, নরসিংদীর পাপিয়াকাণ্ড, ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের হাজার কোটি টাকা পাচারের খবর, বালিশকাণ্ড, নানা ধরনের সরকারি ক্রয়কাণ্ড, নির্মাণকাজে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশকাণ্ডসহ নানা কাণ্ড দেখে মানুষ পাগল হয়ে যেত। কিন্তু না, এত ভয়াবহ অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয় দেখে দেশের জনগণ আজ যেন অসাড় হয়ে গেছে। বরং মনে হয় তারা অপেক্ষায় আছে পরের খবরের জন্য।

সত্যের চেয়ে বিস্ময়কর কিছু নেই। দুর্নীতি নিয়ে সত্য কথা বললে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রথমত অস্বীকার, তারপর প্রতিবাদ এবং শেষে ষড়যন্ত্র খোঁজা হয়। কিন্তু দুর্নীতি হচ্ছে, এসব দেখেও যদি বিষয়টি অস্বীকার করা হতে থাকে তাহলে কি তাদের পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে?

কেননা দুর্নীতিকে অস্বীকার করার মানসিকতাই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য দায়ী। এ কথা সবাই মানেন যে, যেমন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হলে তার চেয়ে দেশের জন্য অগৌরবের আর কিছু হতে পারে না, তেমনি ব্যক্তি হিসেবেও দুর্নীতিবাজ কোনো সম্মানসূচক সম্বোধন নয়। তারপরও দেশে দুর্নীতি চলছে এবং ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি করছেই। এটা তো জানা কথা- দুর্নীতি করার ক্ষমতা না থাকলে দুর্নীতি করা যায় না। 

দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা এবং সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দেয়। তাই শুভবুদ্ধির মানুষ হরহামেশা বলতে থাকেন- দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দেশের বাইরে অর্থ পাচার ও চোরাচালান বন্ধ করতে হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে, সংসদে বিতর্ক ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে, দুদককে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর করতে হবে, বিচার বিভাগের সততা ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে লাখ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে, কারণ এই টাকার মালিক দেশের জনগণ। জনপ্রশাসনে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে, লুটপাটের অর্থনীতি ও রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের সবার নজরে পড়ে, যেমন- নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, সর্বশেষ অস্ত্র-বাণিজ্য বর্তমানে জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করেছে, ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে আর প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে অশ্রদ্ধা তৈরি করেছে। একবার এক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে দুর্নীতি কমবে। সরকারি অফিসগুলোয় পাঁচ বছর আগে বেতন বাড়ানোর কারণে দুর্নীতি অনেক কমে গেছে।’ কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারে না।

পত্রিকার শিরোনামগুলো পড়লে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রাটি বোঝা যায়। দুর্নীতির কথা উঠলে সরকারের মন্ত্রীরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে দুর্নীতি নেই? দুর্নীতি বিএনপি, জাতীয় পার্টির আমলেও হয়েছে। আপনারা সেসব নিয়ে কথা বলেন না। কেবল আওয়ামী লীগ আমলে কিছু ঘটলেই শোরগোল তোলেন।’ তখন আর  কী করা! তবু মনে প্রশ্নটা থেকেই যায়, অতীতের দুর্নীতি কি বর্তমানের দুর্নীতিকে যুক্তিসংগত করবে?

এবার সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্য। তাদের একজন বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে? চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সরকারি কর্মচারীদের হলফনামা আকারে সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান করার দাবি জানান।

একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতিতে না জড়ান, সে জন্য আইন আরও কঠোর করতে পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য অভিযোগ করেন, সরকারি কর্মকর্তারা দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। কিন্তু দোষ হয় রাজনীতিবিদদের।

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে সংসদে বলা হয়, ‘সেখানে (উন্নয়ন ও কেনাকাটা) রাজনীতিবিদদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে জড়িত না থাকেন? ২০১৮ সালে জনপ্রশাসনে তথ্য এসেছিল, ১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছিল। এ রকম হাজার হাজার মতিউর (এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমান) আছেন।’

সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮ নিয়ে আবার ভাবার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাদের গ্রেপ্তারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। এই আইন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছে বলেও মনে করেন তিনি।

বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রে এত দ্রুততর সময়ে এবং এত সহজ উপায়ে অর্থশালী, বিত্তশালী, সম্পদশালী হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ অসম্ভবের সম্ভাবনাপূর্ণ বাংলাদেশে সেটা যে সম্ভব, সেটা তো আমরা স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎ দেখে আসছি। স্বাধীনতার পরবর্তী থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা রাখা কোটিপতিদের পরিসংখ্যান থেকে একটু ধারণা পাওয়া যায়। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। এরপর দুর্ভিক্ষ হলো, বিদেশিদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলো, কিন্তু সে সময়েও কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি থেমে থাকেনি। তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি ছিলেন ৯৮ জন। ১০ বছর পরের হিসাবে দেখা যায় কোটিপতির সংখ্যা ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন। ২০০১ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জনে। 

২০০৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৬৩ জনে। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৫ সালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬। এরপর ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের একটা উল্লম্ফন দেখা যায়। প্রতিবছর ৫ হাজারের বেশি সংখ্যায় কোটিপতি বাড়তে থাকে। যেমন ২০১৯ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ৮৩৯ জনে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০।

 ২০২১ সালে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬। করোনা মহামারি যেমন কোটিপতি বৃদ্ধি থামাতে পারেনি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতির সংকটেও কমেনি কোটিপতি বৃদ্ধি। ফলে সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৯০। 

ব্যাংকের এই হিসাবের বাইরে কালোটাকার সমান্তরাল অর্থনীতির কথা অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন। আর এসব দেখে দেখে ইতোমধ্যে অভ্যস্ততাও গড়ে উঠেছে। কে, কীভাবে, কত দ্রুত হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি বনে গেলেন, এতে আর বিস্মিত হয় না। কেউ মনে করেন ক্ষমতার খেলা আবার অনেকেই এই হঠাৎ বিত্তবান হওয়াকে সৃষ্টিকর্তার অনুদান-কৃপাও বলে থাকেন। প্রভুর অসীম দয়ায় হঠাৎ বিত্তবানদের ভাগ্যবদলের ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবে তারা চরম অনৈতিক ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করেই যে হঠাৎ বিত্তশালী হয়েছেন, সেই সত্যটি জানলেও কেউ বলে না।

২০২২ সালে টিআইবি তাদের এক জরিপে দেখিয়েছিল, ২০২১ সালে ১৭টি খাতের মধ্যে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (সে সময় পুলিশের আইজি বা মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ)। জরিপে ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ৭২ শতাংশ বলেছিলেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। 

টিআইবির হিসাবে সেই সময়ে দেওয়া মোট ঘুষের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এমনকি যা গত বছর উদ্বোধন হওয়া কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ খরচের চেয়েও বেশি। জনগণ ট্যাক্স দেয় উন্নয়নের জন্য আর ঘুষ দেয় সেবা পাওয়ার জন্য। তারা ঘুষ-দুর্নীতির এই ভার আর কতদিন বহন করবে?

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]

মফস্বলে পাঁচ দিন: উন্নয়ন-অবনয়নের খণ্ডচিত্র

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:৫১ এএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:৫১ এএম
মফস্বলে পাঁচ দিন: উন্নয়ন-অবনয়নের খণ্ডচিত্র
ড. তোফায়েল আহমেদ

গত ঈদের অবকাশে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকার কটি গ্রামে গিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি ও নানাজনের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলাম। চট্টগ্রাম শহর থেকে উত্তরে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে এ গ্রামের অবস্থান। অনেক কিছুই দেখলাম, শুনলাম এবং বোঝার চেষ্টা করলাম। তার কিছুটা এখানে তুলে ধরছি। আমি যেমন এলাকার মানুষকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম, এলাকার মানুষও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা খবরবার্তা ‘যাচাই’ করছিলেন। 

যাচাই বলছি এই অর্থে যে, খবরের বিষয়গুলো এমন নয় যে, তারা জানেন না। বিলক্ষণ জানেন। শুধু যাচাই করে নিশ্চিত সত্যায়ন-প্রত্যয়ন করতে চান। যেমন- আমাকে আমেরিকা, চীন ও ভারতের রোহিঙ্গা নীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। ভারতের সেভেন সিস্টারস ও ভবিষ্যতের কথিত ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্রে’র সম্ভাবনা নিয়ে এবং মায়ানমার রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ও রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আদৌ সম্ভব হবে কি না- এ রকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে তৃণমূলের মানুষের এত আগ্রহ অতীতে কখনো দেখিনি। 

অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত রাজনীতিসচেতন মানুষই এসব বিষয়ে আগ্রহ দেখায়। সবচেয়ে বহুল আলোচিত বিষয় হিসেবে সাধারণের আলোচনায় যা উঠে আসে তা ছিল উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ের নানা দুর্নীতি, সমাজে সর্বত্র ন্যায্যতার ঘাটতি, দ্রব্যমূল্য ও সামগ্রিক অব্যবস্থার প্রশ্নাবলি, যথা জোরজবরের স্বরূপ ও উন্নয়ন নৈরাজ্য। যতটুকু সম্ভব বিষয়গুলো খোলামেলা আলোচনা করেছি। তবে কোনো সক্রিয় দলীয় নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে কোনো আলোচনা হয়নি। আমার আগ্রহ ছিল নিতান্তই নিরীহ অদলীয় মানুষ। 

যেসব এলাকা আমি ঘুরলাম, সেগুলো মোটামুটি সচ্ছল গ্রাম। তবে এসব গ্রামে এখন গ্রামীণ পরিবেশ বিদ্যমান নেই, আবার শহরের নৈর্ব্যক্তিক ও সংস্কৃত নাগরিকতাও নেই। একধরনের আধখ্যাঁচড়া অবস্থা। এখানে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তারা আমার পরিচিত। তাই বিশ্বাসযোগ্যতা শতভাগ। কারও কিছু গোপন করার নেই। ঘরবাড়ি, জীবনযাত্রা, সুযোগ-সুবিধা- সবটাই প্রায় শহুরে। 

তবে তারা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন এলাকাভুক্ত নয়। এখনো ইউনিয়ন পরিষদ। প্রধান গ্রামীণ সড়কগুলোতে সড়কবাতি আছে। বড় বড় পাকা দালানবাড়ির বাইরে বৈদ্যুতিক বাতি থাকে, তাতেও সড়ক আলোকিত হয়। প্রবাসী আয়ে বেশির ভাগ বাড়িঘর দালান ও বহুতল বাড়িগুলো নির্মিত। শিক্ষায় এখানে অভিভাবকদের ভালো বিনিয়োগ। গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে চিকিৎসা, প্রকৌশল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। 

এমনও আছে, বাবা-মা প্রাইমারির গণ্ডি পার হননি। শুধু ছেলেদের নয়, মেয়েদেরও বিদেশে পড়াতে পাঠিয়েছেন। সকাল-বিকেল দলে দলে স্কুলের ছেলেমেয়ে দেখা যায়। গৃহবধূদের দোকানে, বাজারে বাজার করতে দেখা যায়। অধিকাংশের পরনে অবশ্য বোরকা থাকে। মানুষ সহজে হেঁটে চলে না। ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং সিএনজিচালিত ত্রি-চক্রযান ব্যবহার করে। নারী-পুরুষ টেক্সি রাইড শেয়ার করে নিঃসংকোচে। নারী-পুরুষ উভয়ের গতিশীলতা ও বহিঃগমন বেড়েছে। 

ছেলেদের চুলের কাট ও ছেলেমেয়ে সবার পোশাক-পরিচ্ছদে আধুনিকতা। বহুমুখী ব্যবহার্য মোবাইল ফোন হাতে হাতে। মহাসড়কে বাস নেই বললেই চলে। রাস্তাজুড়ে শত শত সিএনজিচালিত সবুজ টেক্সি। এক টেক্সিতে কমপক্ষে পাঁচজন। দুই থেকে পাঁচ মিনিটেই এসব টেক্সি পাওয়া যায়। খুব কম লোক হাঁটতে চায়। সামান্য দূরত্বেও টেক্সিতে ওঠে। সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা ভাড়া। টেক্সিতে না উঠে রাস্তায় হাঁটার উপায় নেই। যানবাহনের গতি, ওভারটেক ইত্যাদির কারণে হাঁটা খুবই অনিরাপদ। সঠিক সংখ্যা না গুনে থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু অনেক লোক দেখলাম। গ্রামে মসজিদ, মক্তব, মন্দিরের সংখ্যা বেড়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নতি চোখে পড়ার মতো। 

স্কুল-মাদ্রাসাও একইভাবে পূর্বাপেক্ষা অবকাঠামোগত দিক থেকে উন্নত। মসজিদগুলো জুমা ছাড়াও প্রতি ওয়াক্তে দুই-তিন সারি মুসল্লি এবং স্কুল-মাদ্রাসাগুলোও শিক্ষার্থীতে পরিপূর্ণ। প্রতিটি মসজিদে উচ্চ শব্দের মাইকে আজান এবং ওয়াজ চলে। প্রায় রাতে কোনো না কোনো তরিকা ও সঙ্ঘের সভা-সম্মেলন হয়। গ্রামের সনাতনী হাটবাজার নির্ধারিত হাটবারে আগের মতো জমে না। বড় সড়কের দুই পাশজুড়ে দোকানপাট। এক হাটের সঙ্গে আরেক হাটের সীমারেখা বজায় নেই। 

সড়ক পাশের দোকানপাট এক হাটের সঙ্গে আরেক হাটকে যুক্ত করে নিয়েছে। হাটবারের দরকার হয় না। সকাল-সন্ধ্যা সবখানে বাড়ির কাছেই মাছ-মাংস, তরকারি সবই পাওয়া যায়। গ্রামের ভেতরেও প্রচুর ছোট ছোট দোকান। অনেক বাড়িতে দেখলাম সকালের নাশতা দোকান থেকে কিনে আনা হয়। পরোটা, নানরুটি, পাউরুটি হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। সকালে নানা দোকানে লাইন করে এসব কেনা হচ্ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও একটি সংবাদপত্র কেনার জন্য একজন হকারের সন্ধান পেলাম না। এখানে সংবাদপত্র কেউ পড়ে বলে মনে হলো না। এ পর্যন্ত যা বলা হলো তার সবই হয়তো অর্থনৈতিক বা সচ্ছল জীবনের নতুন সাংস্কৃতিক রূপান্তরের পরিচয় বহন করে।

এবারে সবিস্তারে বর্ণনা না দিয়ে চারটি ঘটনার উল্লেখ করছি, তাতে সামাজিক পরিবর্তনের একটি ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। ঘটনা এক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবক্ষয়। আমার কথিত গ্রাম এলাকায় চারটি প্রাইমারি স্কুল ও একটি উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে। উচ্চবিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৬৮ সাল। কিছুদিন ধরে স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল খুবই শোচনীয়। গত বছর কতজন পরীক্ষা দিয়েছে, স্কুল বন্ধ থাকায় তা জানতে পারিনি। তবে এ বছর প্রায় ৯৭ জন ডাহা ফেল করেছে। হয়তো দুই-তৃতীয়াংশ। লাগাতার আগের বছরগুলোতেও ফলাফল এ রকমই ছিল। 

নবম-দশম শ্রেণির দু-একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজি পড়ানোর যোগ্য শিক্ষক নেই। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নানা রাজনীতি। বিজ্ঞান বিষয়ে কোনো ব্যবহারিক ক্লাস-পরীক্ষা হয় না। প্রতি পরীক্ষার আগে কিছু টাকা দিতে হয়, তাতে কাজ সেরে যায়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নিয়ে মানুষের বিস্তর অভিযোগ কিন্তু বলার কোনো জায়গা নেই। তারা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। শিক্ষকদের গায়ে হাত উঠেছে, এ রকমও শোনা গেল। ঘটনা দুই. কারও বিপদে কেউ নেই। 

এলাকায় বেশ কিছু ছোট, মাঝারি ও বড় গরু মোটাতাজাকরণ খামার রয়েছে। কোরবানি বাজারের জন্য পশুপালন করা হয়। কোরবানির মাস দেড়েক আগে অভিনব কায়দায় একটি খামার থেকে ছয়টি গরু লুট হয়ে যায়। একটি মিনি ট্রাক ও একটি টয়োটা হাইয়েজ নিয়ে রাত ২টার দিকে পাঁচ-ছয়জন ডাকাত আসে। তারা ২০ মিনিটের মধ্যে গরুগুলো নিয়ে চম্পট দেয়। একজন বাড়ি থেকে বের হন। তাকে ডাকাত দল তারই লুঙ্গি ও শার্ট খুলে এমনভাবে বাঁধে, তার জীবন শঙ্কা দেখা দেয়। পাড়ার লোকজন সকালে জানতে পারে। থানা, পুলিশ, সমাজ, ইউনিয়ন পরিষদ কেউই কিছু করেনি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউই কারও বিপদে বা দুর্দিনে এগিয়ে আসছে না। 

ঘটনা তিন. উন্নয়নের শিলালিপি। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত মহাসড়ক। মহাসড়ক থেকে গ্রামের দিকে নেমে গেছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা জেলা পরিষদ সড়ক। ওই সড়ক থেকে ছোট ছোট ৫, ১০, ১৫, ২০, সর্বাধিক ৩০ মিটারের বিভিন্ন বাড়ির প্রবেশপথ। সবগুলো প্রবেশপথ চারটি উৎসের অর্থ ব্যবহার করে কংক্রিট বিছিয়ে পাকা করা হয়েছে। 

প্রতিটি বাড়ির প্রবেশপথের কংক্রিট ঢালাইয়ের প্রকল্প মূল্য ১ লাখ টাকা। কোনোটা ১ লাখে না হলে পরেরবার নতুন প্রকল্প করা হয়। আধা কিলোমিটার সড়ক জলমগ্নমুক্ত রাখার জন্য রাস্তার দুই পাশ বা এক পাশে ছিল সরু জলনিষ্কাশনি পরিখা। স্থানীয় ভাষায় ‘গড়খাই’। এসব জল নিষ্কাশনি গড়খাই পার্শ্ববর্তী বাড়িভিটার মালিক তাদের সীমানাভুক্ত করে নিয়েছেন। এখন পানি সরে না। তাই এলাকাজুড়ে এক ফুট গভীর ও আট-দশ ইঞ্চি প্রস্থের অনেক পাকা ড্রেন। 

এভাবে গ্রামীণ সড়কে খণ্ড খণ্ড পাকা ড্রেন। যার কোনো আউট ফল নেই। ড্রেনের পানি কোনো নালা-নর্দমায় পড়ার ব্যবস্থা নেই। মাঝে মাঝে রাস্তায় ড্রেন। এ যেন সেই শূন্যে ঝুলে থাকা ব্রজের মতো, যার কোনো সংযোগ সড়ক নেই। ড্রেনগুলো প্রায় বন্ধ এবং কালো বিষাক্ত পানি জমে মশার আবাস। বাড়ির প্রবেশপথগুলোর প্রতিটির মুখে শিলালিপি রয়েছে। প্রতিটি শিলালিপিতে তিন থেকে চারজনের নাম। 

একই বাড়ির প্রবেশমুখে তিনটি শিলাও দেখা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতি ১০-১২ মিটার ড্রেনেও শিলালিপি। কোনোটিতে স্থানীয় এমপি, নিচে এমপির কোনো চামচা, যার কোনো পদ-পদবি নেই। কোনোটিতে জেলা পরিষদ সদস্য/সদস্যা, প্রকল্প কমিটির সভাপতি, কোনোটিতে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার, আবার কোনোটিতে উপজেলা পরিষদ সভাপতি ও অন্য 
দু-একজন। এভাবে আধা কিলোমিটার গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে প্রায় ২০টি শিলালিপি। ওই প্রবেশপথগুলোর আবার নামকরণ হয়েছে নানা প্রভাবশালীর বাবা-মা, ভাইবেরাদরের নামে। 

একজন মজা করে বললেন, কোনো দিন কোনো কারণে এসব এলাকা ধ্বংস হয়ে মাটিচাপা পড়ে গেলে এবং কখনো যদি খনন করে এ সভ্যতার পরিচিতি নির্ণয় করা হয়, তাহলে একটি নতুন পাথর যুগের সন্ধান মিলতে পারে। ‘উন্নয়ন শিলাপ্রস্তর যুগ’। এভাবে সারা ইউনিয়নের ৮-১০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে হাজারের কাছাকাছি ভিত্তিপ্রস্তর ও পরিচিতির শিলালিপি দেখা যাবে। সরকারি অর্থ উন্নয়নের সঙ্গে প্রস্তরখণ্ডে নিজের নাম খোদাই করার এ হিড়িক অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব। অথচ ওই এলাকার ঐতিহ্যগতভাবে পানি নিষ্কাশনি নালা-নর্দমা, খাল-ছড়াগুলো ভরাট ও বেদখল। গ্রামের মূল সড়ক খানাখন্দ ও গর্তে ভরা। ঘটনা চার. পোস্টার শুভেচ্ছা। রাস্তায় রাস্তায় শুভেচ্ছা পোস্টার। 

পাঁচ-ছয়জনের ছবি। নিচে একজনের বড় ছবি। তিনি হয়তো বড় নেতা নন। এভাবে ছোট ও মাঝারি নেতাদের বড় বড় ছবি। বিষয় ঈদের শুভেচ্ছা। নেতা বড়, ছোট, মাঝারি, পাতি ও তস্যপাতি। তোমার এ শুভেচ্ছায় মানুষের কী আসে যায়! এক বাটি মাংস, এক বাটি ফিরনি কিংবা সামনে এসে একটি সালাম দিয়ে যদি বলতে ‘ঈদ মোবারক’, তাহলে অন্য কিছু না হলেও একটি রাজনৈতিক গণসংযোগ বলা যেত। 

এ জাতীয় অসুস্থ সংযোগরহিত পোস্টার শুভেচ্ছা এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একজন বললেন, আমি তার শুভেচ্ছার নিকুচি করি। সে কে, কোথাকার হরিদাস পাল? রাস্তায় পোস্টার সেঁটে শুভেচ্ছা জানায়! এগুলো চাঁদাবাজির একটি কৌশল। এভাবে আমাদের গ্রাম, শহর সর্বত্র নতুন উন্নয়নের আশকারায় নবতর এক সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটছে। বিষয়গুলো গভীরভাবে অধ্যয়নের অবকাশ দাবি রাখে।

লেখক: শিক্ষক ও শাসনবিষয়ক গবেষক
[email protected]