![প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক গুরুত্ব](uploads/2024/07/03/D. Sultan-mahmun-1719982095.gif)
আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যাওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ভারত সফরের দুই সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের বিষয়টি আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সঙ্গেও উন্নয়ন অভিযাত্রায় অংশীদার হিসেবে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকতে চায় চীন।
পরিস্থিতিগত কারণে আঞ্চলিক উদীয়মান দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের কড়া নজর রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে দেশ দুটি। এটিকে কাজে লাগানোর কৌশল নিয়ে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি অনুসরণ করেই টানা চার মেয়াদে এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।
আর এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর ও আসন্ন চীন সফর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এমন অবস্থাকে দৃশ্যত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একধরনের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মাইলফলক হিসেবে লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বন্ধুত্ব স্থাপনের রোল মডেল হিসেবেও বিষয়টিকে তুলে ধরা যায়।
বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশে প্রভাব বিস্তারের একধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে ভারত ও চীনের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল ও জোরদার করার প্রচেষ্টা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক একীভূতকরণে বিশেষ অবদান রাখবে।
আমরা লক্ষ করেছি যে, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত ও চীনের সঙ্গে এমন চমৎকার ‘ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক’ বজায় রেখে চলেছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক।
প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ভারত বাংলাদেশের বিপদের বন্ধু আর চীন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারসাম্যের কূটনীতি স্পষ্ট। তিনি ভারত এবং চীন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান এবং সেই নীতি অনুসরণ করেই চলেছেন এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সমাধানের জন্য চীনের কোনো বিকল্প নেই বলেও বাংলাদেশ মনে করছে। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। তাই ভারসাম্যের কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দূরদর্শিতার স্পষ্ট ছাপ রাখবে বলা যায়।
অন্যদিকে চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক নির্ভরতায় যুক্তরাষ্ট্র এই সফরের দিকে তাকিয়ে থাকবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এই অঞ্চলে এখন চীনের একাধিপত্য প্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো দেশগুলো চীনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দৃষ্টি থাকাটাই স্বাভাবিক।
নানাবিধ বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক বিষয়ের সঙ্গে আঞ্চলিক-রাজনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশরূপে পরিগণিত। ফলে বৃহৎ পরাশক্তির রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে নতুন করে সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
ভারত চায় ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকুক। চীনের প্রত্যাশাও বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকবে। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এটি সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা পালন অতি তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত ১৫ বছরের অধিক সময় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপম নেতৃত্বে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বরাজনীতি-আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় উচ্চাসনে সমাসীন।
বাংলাদেশ আজ একটি উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বনেতাদের কাছেও বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির হার-শিল্প উন্নয়নসহ সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ, রাজনৈতিক পরিপক্বতা সর্বোপরি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ অধিকমাত্রায় সমাদৃত। কৌশলগত কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবদান অপরিসীম।
ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখ্যা, সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। যার ৫৮ শতাংশই তরুণ। কর্মশক্তি ও ভোক্তা- এই দুই হিসাবেই সংখ্যাটা অনেক। এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ।
জিডিপির পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্বের যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে। সমতল ভূমির ক্ষেত্রে যেটা ২৫ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিক পরাশক্তিদের দৃষ্টি এই অঞ্চলে নিবদ্ধ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত ও উন্নয়নে অংশীদার চীনসহ সবার সঙ্গে নিবিড় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতিতে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে।
ভূ-রাজনীতিতে যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান আঞ্চলিক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম সারথি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আর এ কারণেই ভারত সফরের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চলেছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের চাহিদার ক্ষেত্রগুলোতে ভারত বেশ মনোযোগী। বাংলাদেশও এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক যত বেশি ভারসাম্যমূলক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিমুখী হবে, তত বেশি আমাদের দেশের জনগণের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
তাই কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায়ের মাধ্যমে ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার হাতকে আরও মসৃণ করবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফর দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীল রাজনীতিতে শক্তিশালী ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করবে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফরের অভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা হলো দেশের উন্নয়নকে যেমন এগিয়ে নেওয়া, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভারসাম্য নীতি প্রতিষ্ঠিত করা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]