![সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির বিপুল সম্পদের সন্ধান](uploads/2024/07/03/Lead-1719984214.jpg)
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও বিআইডব্লিউটিএর সাবেক চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার এবং তার স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের দুজনের অবৈধ সম্পদ অন্তত ৩০ কোটি টাকার। এর মধ্যে শামসুদ্দোহার ২ কোটি ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা খন্দকারের প্রায় ২৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে।
এ-সংক্রান্ত দুটি মামলার তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতে পৃথক দুটি চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। শামসুদ্দোহা দুই চার্জশিটেই আসামির তালিকায় আছেন। একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারির আবেদন জানানো হয়েছে। গতকাল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর দুদকের উপপরিচালক (বর্তমানে পিআরএল ভোগরত) শাহীন আরা মমতাজ বাদী হয়ে দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ পৃথক দুটি মামলা করেন। তিনি মামলার তদন্ত শেষে ২০২২ চার্জশিট দাখিলের অনুমতি চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এরপর গত বছর মে মাসে কমিশন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করে দুদকের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলমকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। খোরশেদ আলম পুনরায় তদন্ত করে সম্প্রতি চার্জশিট দাখিলের অনুমতি চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কমিশন এই প্রতিবেদন অনুমোদন করলে গতকাল আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এদিকে শামসুদ্দোহা গুলশানে সরকারি বিলাসবহুল বাড়ি অবৈধভাবে দখলে রেখে ৮ বছর ধরে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।
একটি চার্জশিটে শামসুদ্দোহার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলক্ষেত ও ঢাকার নবাবগঞ্জে ৩৫টি দলিলে ৫৬৩ শতক জমির মালিকানার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এক্সিম ব্যাংক করপোরেট শাখায় ০৩৯১২১০০২০৫৭০১ অ্যাকাউন্টে জমা ১৪ কোটি ১৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৫৫ টাকা পাওয়া যায়। তিনি অর্গানিক অ্যাগ্রো ফার্মস নামে একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দেখিয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে অন্তত ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ নেন।
এ ছাড়া তার নামে ২৫ লাখ টাকা করে তিনটি অ্যাকাউন্টে মোট ৭৫ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। এভাবে তার নামে ২১ কোটি ৫ লাখ ৯ হাজার ৭৩৭ টাকার সম্পদ রয়েছে। তিনি দুদকে দাখিল করা সম্পদবিবরণীতে ১২ কোটি ৬০ লাখ ৯৯ হাজার ৫১৬ টাকার সম্পদের মালিকানা দাবি করেন। ফলে তিনি ৮ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার ২২১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এর মধ্যে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৫৭ লাখ ৩ হাজার ৩৭৮ টাকা।
শামসুদ্দোহার বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটে ৩৪টি নথি ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ দাখিল করা হয়েছে এবং তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অপর চার্জশিটে শামসুদ্দোহার গৃহিণী স্ত্রী ফেরদৌসীর নামে রাজধানীর নিকুঞ্জে ৫ শতক, খিলক্ষেতে ৩৭ শতক, গুলশানের বিভিন্ন মৌজায় ৮৮ শতক, গাজীপুরের বিভিন্ন মৌজায় ৪.৬৪ একর ও নবাবগঞ্জে ১২.৮৭ একর জমিতে ওয়ান্ডারেলা গ্রিন পার্ক জমির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। তার নামে এক্সিম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও প্রাইম ব্যাংকসহ বিভিন্ন অ্যাকেউন্টে বিপুল পরিমাণ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে।
সব মিলে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ৪১ কোটি ২৯ লাখ ১২ হাজার ৩১ টাকা জমা ও উঠানো হয়েছে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক করপোরেট শাখায় ০৩৯১২১০০০৭৯৭৯১ অ্যাকাউন্টে জমা ৩৫ কোটি ২৭ লাখ ১২ হাজার ২৪৮ টাকা পাওয়া যায়, যা ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তিনি উত্তোলন করেন।
তার নামে মোট ৩১ কোটি ৪৯ লাখ ১ হাজার ৮৯১ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুদকে দাখিল করা সম্পদবিবরণীতে তিনি ৩ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকার সম্পদের মালিকানা দাবি করেন। ফলে তিনি ২৮ কোটি ৪৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। এর মধ্যে ২৭ কোটি ৪৮ লাখ ৮২ হাজার ৪৯১ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত বলে দুদকের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ফেরদৌসীর বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটে ৩৪টি নথি ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ দাখিল করা হয়েছে এবং তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
সরকারি বাড়ি দখল: গুলশান ১৩৫ নম্বর রোডের এসইএস (এ)৬ নম্বর প্লট। এক বিঘা জমির ওপর নির্মিত সরকারি ডুপ্লেক্স বাড়ি। গত আট বছর এই সরকারি বাড়িতে আছেন শামসুদ্দোহা। এ সময়ে তিনি কোনো ভাড়া দেননি। উল্টো বাড়িটি এককালীন বরাদ্দ চেয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। তবে পূর্বাচলে আরেকটি প্লট পাওয়ায় আবেদন নাকচ হয়।
তবু তিনি বাড়িটি ছাড়েননি। তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে একবার ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ দেয় আবাসন পরিদপ্তর। তবে পুলিশের প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। এর পর আবাসন পরিদপ্তর আর কখনো তাকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেনি।
বিলাসবহুল ওই বাড়িতে একসময় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ থাকতেন। তিনি অবসরে যাওয়ার পর ২০০৮ সালে আবাসন পরিদপ্তর পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শামসুদ্দোহা খন্দকারকে বসবাসের জন্য ওই বাড়ি বরাদ্দ দেয়। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর শামসুদ্দোহা খন্দকার প্রেষণে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ওই বছরের ৪ মার্চ তিনি অবসর-উত্তর (পিআরএল) ছুটিতে যান। পিআরএলে থেকেও তিনি বাড়িটির দখলে থাকেন। এরপরও তিনি বাসাটি ছাড়েননি। ঢাকায় থাকার মতো তার কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট না থাকার কারণ উল্লেখ করে ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়িটি এককালীন বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেন। পূর্ত মন্ত্রণালয় আবেদনটি নাকচ করলে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন।