খুলনার উপকূলীয় কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সর্বশেষ ২০ জুন কয়রা, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটায় একই দিনে বজ্রপাতে চারজনের মৃত্যু হয়। বৃষ্টির সময় খোলা জায়গায় নদী বা ঘেরে মাছ ধরার সময়, মাঠে গরু আনতে যাওয়া বা কৃষিকাজে থাকার সময় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এ ছাড়া নিজ ঘরে অবস্থান, মোবাইল টাওয়ারের নিচে থাকা ও ইটভাটায় কাজ করার সময় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বজ্রপাতে হতাহতদের বিবরণ ও অনুদানের তালিকা থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ জুন বজ্রপাতে কয়রার ঘড়িলাল গ্রামে মোহাম্মদ আলীর ছেলে এনায়েত আলী (৩৭), মাটিয়াডাঙ্গা গ্রামে আল আমিনের ছেলে নাজমুল (৮), পাইকগাছায় দেলুটি ইউনিয়নের পতিত মণ্ডলের ছেলে শ্রীকান্ত মণ্ডল (২৫) ও বটিয়াঘাটায় মনি চৌকিদারের ছেলে আল মামুন (১৭) মারা যান। এর মধ্যে পাইকগাছার শ্রীকান্ত মৎস্য ঘেরের কর্মচারী ছিলেন। বৃষ্টিপাতের সময় ঘেরের একটি ঝুপড়ি ঘরে অবস্থান করছিলেন। এ ছাড়া বেড়াতে গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে আলাদা একটি মৎস্য ঘেরের বাসায় আশ্রয় নেন কয়রার এনায়েত ও নাজমুল। হঠাৎ সেখানে বজ্রপাত হলে তাদের মৃত্যু হয়।
একইভাবে ৫ জুন খুলনার ডুমুরিয়া খর্নিয়ায় ত্রিশ বছর বয়সী দিদারুল শেখ, ১১ মে ডুমুরিয়া মাগুরাঘোনা গ্রামে সোহান গাজী (২৮), ৩ এপ্রিল ডুমুরিয়ায় ওবায়দুল্লাহ গাজী (২৭) বজ্রপাতে মারা যান।
পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান রাম কৃষ্ণ টিকাদার খবরের কাগজকে বলেন, কয়েক বছর ধরেই উপকূলীয় এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই এলাকায় বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র জেলে বা কৃষক, যারা জীবনের তাগিদে বৃষ্টির মধ্যেও নদীতে মাছ ধরা বা খোলা মাঠে কাজ করেন। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে বা ঘরে অবস্থানের সময় বজ্রপাতেও কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের সময় মাঠে বা খোলা জায়গায় যেখানে উঁচু কোনো গাছ নেই বা বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নেই, সেখানে যারা অবস্থান করেন বজ্রপাতের মৃত্যুঝুঁকি তাদের বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে বজ্রপাতে কম-বেশি ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়।
খোলা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি
খুলনা জেলা প্রশাসন ২০১৫ থেকে ২০১৮, ২০২২ ও ২০২৩ সালে বজ্রপাতে নিহত ৪১ জনের পরিবারকে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা অনুদান দেয়। তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছায় বৃষ্টির মধ্যে নদীতে বা ঘেরে মাছ ধরার সময় ১৮ জন, জমিতে কৃষিকাজ বা গরু নিয়ে ফেরার পথে ১৫ জন, মোবাইল টাওয়ারের নিচে অবস্থানের সময় একজন, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুজন ও ইটভাটায় কাজ করার সময় দুজনের মৃত্যু হয়। বাকি তিনজনের মৃত্যু হয় নিজ ঘরে অবস্থানের সময়ে। নিহতদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সের ২১ জন, ৪১-৫০ বছরের মধ্যে তিনজন, ৫১-৭০ বছরের মধ্যে ১৩ জন ও শিশু চারজন। নিহতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩০ ও ১১ জন নারী আছেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস’- এসএসটিএএফ ফোরাম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বজ্রপাতে মারা যাওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল জানান, বৃষ্টির মধ্যে অসতর্কতাবশত খোলা মাঠে থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাই বেশি। এ ছাড়া নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
মোবাইল, ব্যাটারি বাড়ায় বজ্রপাতের ঝুঁকি
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মোবাইল, ব্যাটারি (স্থির বিদ্যুৎ) বা এ ধরনের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যবহারের পর তা প্রকৃতিতে ফিরে যায়। মূলত যেখানে ঘরবাড়ি বা গাছপালা থাকে না- এমন খোলা জায়গায় এসব জমা হয়। এখানেই বজ্রপাতে বিদ্যুতের আকর্ষণটা বেশি থাকে। ফলে খোলা জায়গায় ধানখেতে মানুষ বেশি মারা যায়। মোবাইল, ব্যাটারি, চার্জার ব্যবহারের মাত্রা যত বাড়ছে, বজ্রপাতের ঝুঁকিও তত বাড়ছে।
তিনি বলেন, একজন মানুষের পায়ে যদি স্যান্ডেল থাকে, তা হলে তার বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। গ্রামে খোলা মাঠে যারা কাজ করেন, তাদের পায়ে স্যান্ডেল থাকে না। ফলে বিদ্যুৎটা তার সারা শরীরে প্রবাহিত হয়।
বজ্রপাতে মৃত্যু এড়াতে বৃষ্টির মধ্যে যারা মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, তাদের রাবারের স্যান্ডেল পরে কাজে যাওয়া উচিত। এ ছাড়া বেশি বেশি গাছ লাগানো, বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ ও বজ্রপাতের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া উচিত।