বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ) আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মোট ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে আয়ের উৎস হিসেবে নতুন ২৭টি খাত বেছে নিতে পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে।
বিইএ বাজেট প্রস্তাবনায় একটি জনকল্যাণকামী শোভন সমাজ-অর্থনীতিব্যবস্থা বিনির্মাণের তাগিদ দিয়ে বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ ও দেশের অর্থনীতি গড়তে হবে। প্রস্তাবনায় বাজেটের শীর্ষ সাতটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে বৈষম্য-অসমতা-দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক সুরক্ষা ও মানবকল্যাণ নিশ্চিতকরণ, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি সাধন, সরকারের ঋণনির্ভরতা কমানো এবং কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ।
গতকাল সোমবার রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিইএ সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আইনুল ইসলাম ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৪-২৫’ উপস্থাপন করেন।
আইনুল ইসলাম জানান, বর্তমানে কর জিডিপির হার মাত্র ৯ শতাংশের মতো, যা প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়েও কম। এর পরিমাণ সহজেই দ্বিগুণ বা ১৭-১৮ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে ২৭টি আয়ের পথ আমরা সরকারকে দেখিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাতগুলো হলো, কালোটাকা ও পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার এবং তা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনা, সম্পদ কর প্রয়োগ, অনলাইন ব্যবসায় কর ও ভ্যাট আদায়, বিলাসী পণ্য ক্রয় ও ব্যবহারের ওপর করারোপ, সংসদ সদস্যদের দেওয়া সব করসুবিধা প্রত্যাহার, সরকারি পরিষেবার বিপরীতে প্রাপ্য আয়ে করারোপ, বিমান পরিবহন ও ভ্রমণ কর, রয়্যালটি ও সম্পদ থেকে আয়ে কর, প্রতিরক্ষাবাবদ প্রাপ্তি, রেলপথ, ডাকবিভাগ, তার ও টেলিফোন, সেচ ও বিদ্যুৎ, সরকারি সম্পদ বিক্রয়, বিদেশি পরামর্শ ফির ওপর কর, টেলিকম, এনার্জি, বিমা ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের আয়ে কর এবং হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ও নবায়ন ফি।
বিইএ-এর বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় কালোটাকা ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে জোর দিতে বলা হয়। একটি বছরওয়ারি হিসাব দিয়ে বিইএ জানায়, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫০ বছরে পুঞ্জীভূত পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এ অর্থের শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ বা ন্যূনতম ৫ হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বলা হয়, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫০ বছরে পুঞ্জীভূত কালোটাকার পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। এ অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনা জরুরি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে বিইএর সাবেক সভাপতি ড. আবুল বারাকাত বলেন, দুর্নীতি রোধ, কালোটাকা ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে আমরা বিইএ-এর পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছি। এ কমিশনে কোনো আমলা, সামরিক বা পুলিশ বাহিনীর কেউ, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, রাজনৈতিক দলের সদস্য ও গণমাধ্যমের মালিক সদস্য হতে পারবেন না। এ কমিশনের কাজ হবে দুর্নীতি, কালোটাকা ও অর্থ পাচার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান ও জনগণের কাছে গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রতি তিন মাস পরপর কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রতিবেদন নিয়ে সরাসরি হাজির হওয়া। এতে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
তিনি বলেন, পুঞ্জীভূত কালোটাকা ও পাচারকৃত অর্থ ছড়িয়ে আছে জমি, বাড়ি ও সোনাদানায়। আমরা গবেষণা করে দেখেছি যে, ৪৬টি বিভিন্ন ধরনের ও পর্যায়ের গোষ্ঠী এতে জড়িত।
তিনি জানান, কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ৩৩ থেকে ৬৬ শতাংশ হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একবার কালোটাকা নিয়ে একটি গবেষণা বা স্টাডি হয়েছিল। ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। আমরা জানি, কালোটাকা আছে। আবার এটাও জানি যে, সেসব উদ্ধারও কঠিন।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ইতোপূর্বে গঠিত কমিশনের ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি। তাই এখন কোনো কমিশন গঠন করা হলে কমিশনের নখ থাকতে হবে, যেটা তারা কাজে লাগাতে পারবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
এর আগে সংবাদ সম্মেলনে বিইএর বর্তমান সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দেশের সর্বত্র দুষ্টচক্র আছে। এ দুষ্টচক্রে রয়েছে ব্যক্তি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী। এরা এতটাই তৎপর যে, সরকারও কোনো ভালো কাজ করতে চাইলেও পারছে না। আমরা যা চাই, জনগণ যা চায়, তা সরকারও চায়। কিন্তু দুষ্টচক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তার প্রভাবে দেশে ন্যায্যতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের কথা বলছেন! ওখানে দুষ্টচক্র আছে। দুষ্টচক্র আছে পেঁয়াজের বাজারে, আলুর বাজারে ও ডলারের বাজারে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণেও আছে দুষ্টচক্র। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা কদিন ধরে তা দেখছি। দুষ্টচক্র সর্বত্র আছে। এরা ব্যক্তি হতে পারে, গোষ্ঠী হতে পারে। পরস্পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এরা খুব শক্তিশালী। এদের দমন করতে হবে। যারা এ দুষ্টচক্রের সদস্য, তাদের দমন করা না গেলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
বিইএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, অর্থনীতিকে পরিচালনা করেন রাজনীতিকরা। তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে কালোটাকা বন্ধ করা বা উদ্ধার করার বিষয়টি। আমাদের পরামর্শ হলো, সব লেনদেন ডিজিটাল করতে হবে। তাতে সব লেনদেনের রেকর্ড থাকবে। লেনদেন যদি সন্দেহজনক হয়, তা শনাক্তকরণ সহজ হবে।
বিইএ বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়, সরকার যে বাজেট করে, তাতে উন্নয়ন বনাম পরিচালন ব্যয়ের অনুপাত হয় ৩৮: ৬২ শতাংশ। বিকল্প বাজেট প্রস্তাব প্রস্তাবে বিইএ কর্তৃক এ অনুপাত হবে ৬৬: ৩৪ শতাংশ। বিকল্প বাজেটে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১০ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো।
বিকল্প বাজেটে নবজাতক শিশুর থাইরয়েড স্ক্রিনিং খাতে পৃথকভাবে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, আগামী অর্থবছরে শিল্প ও আর্থিক সেবা খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৮৯ গুণ বাড়ানো (বর্তমান ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকার চারগুণ বেশি ২১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকায় উন্নীতকরণ), নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এবং নারীর বিজ্ঞান শিক্ষায় ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে বিএই।
বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে প্রশাসনিক সংস্কারের আওতায় ১৬টি নতুন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কিংবা অধিদপ্তর সৃজনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ‘গণপরিবহন মন্ত্রণালয়’ ও ‘গবেষণা, উদ্ভাবন, বিচ্ছুরণ ও উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ নামে ২টি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় গঠনের কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়াও নতুন করে যেসব প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে শিশুবিকাশ বিভাগ, বিধিবদ্ধ রেশনিং বিভাগ, আদিবাসী মানুষের জীবন কুশলতা বিভাগ, সর্বজনীন পেনশন বিভাগ, কারিগরি শিক্ষা বিভাগ, প্রবীণ হিতৈষী বিভাগ, নারীর ক্ষমতায়ন বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘নারীর বিজ্ঞান শিক্ষা বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার বিভাগ সৃষ্টি ও হাওর-বাঁওড়-বিল-চর-উপকূল উন্নয়ন বিভাগ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগ, অনু ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিভাগ এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। এর বাইরে ৩৯টি জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিভাগীয় পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দিয়েছে বিইএ।
বিইএর বিকল্প বাজেটে বলা হয়, বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই তার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করতে হবে। নবজাতক শিশুর এ অধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মায়ের সুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সুযোগ-সুবিধা।