![শামখোল ও ইরিধান](uploads/2024/05/03/bird-1714714170.jpg)
বাংলাদেশের হাওর-বিলে শামখোল পাখির সংখ্যা বাড়ছে জেনে আপনি হয়তো বিস্মিত হবেন। কিন্তু বিগত তিন দশক ধরে জলচর পাখি গণনার ফলাফল দেখে আমরা নিশ্চিত, এ দেশে শামখোলের সংখ্যা সত্যই বেড়েছে। পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে দুঃসংবাদ-ভারাক্রান্ত এই দিনে এ এক বিরল সুখবর। সত্তর বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, বিশ্বের সব শামখোল অচিরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাংলার নদী-চরে ও বাদাভুঁইয়ে দল বেঁধে হেঁটে বেড়ানো বিশাল এই পাখি শামখোল, শামুকখোল ও শামুক-ভাঙা ইত্যাদি নামে পরিচিত। ‘মানিকজোড়’ বা ‘স্টর্ক’ পরিবারের যে ছয় প্রজাতির পাখি আজও বাংলাদেশে টিকে আছে, তার মধ্যে শামখোল সবচেয়ে বেশি সুপরিচিত ও বিস্তৃত। এ পরিবারের অপর পরিচিত পাখি ‘মদনটাক’ এখন বেশ বিরল এবং বাদবাকি সবাই অতিবিরল হয়ে গেছে।
শামখোলও কিন্তু আর সব মানিকজোড়ের মতোই বিশালাকার পাখি এবং এর আহার ও বাসস্থানের চাহিদাটাও বড়। জনাকীর্ণ এই দেশে আর সব বড় পাখির মতো শামখোলের সংখ্যাও কমে যাওয়ারই তো কথা। বিশেষ করে গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে ক্ষতিকর কীটনাশক ‘ডিডিটি’ ব্যবহারের ফলে এ দেশের অন্যান্য বড় পাখির সঙ্গে শামখোলেরও বিলুপ্ত হওয়াটা প্রায় নিশ্চিতই ছিল।
শামখোল পাখির ইংরেজি নাম ‘ওপেন বিল’ বা খোলা-চঞ্চু। দুই পাটি চঞ্চুর মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা থাকে বলেই এ পাখির এই নাম। চঞ্চুর এই আজব ফাঁকটির জন্যই এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ হয়েছে ‘অ্যানাস্টোমাস অসিটান্স’, যার অর্থ হাই তোলা মুখ। শামখোল যেন আজীবন মুখ হাঁ করে আছে, দুনিয়ার আর সব পাখির মতো সে কখনো দুই চঞ্চু এক করতে পারে না।
বাংলার মানুষ কিন্তু এ পাখির চঞ্চুর বিশেষত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে এর নাম দিয়েছে শামুক-ভাঙা অথবা শামুকখোল এবং সংক্ষেপে শামখোল। শামখোল পাখির নাতিদীর্ঘ খাদ্যতালিকায় প্রথমেই আছে শামুক ও ঝিনুক। শামুক-ঝিনুকের শক্ত খোলস খুলে ফেলার জন্যই শামখোলের চঞ্চুর ওই আজব আর্কিটেকচার, যা আর কোনো পাখির নেই।
শামখোলের অদ্ভুত চঞ্চু নিয়ে প্রাচীন পাখি বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জুলিয়ান হাক্সলি ভেবেছিলেন, হয়তো দুই চঞ্চুর ফাঁকে ফেলেই পাখিটি শামুক ভাঙে। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। শামখোল তার চঞ্চুর চোখা প্রান্ত দিয়েই শামুক ভাঙে। পানির মধ্যে চঞ্চুর প্রান্ত ডুবিয়েই সে শামুকের খোলস ভেঙে মাংস বের করে নেয়। পানির তলে পড়ে থাকে শামুকের খোলস।
শামুক ভাঙার কাজে শামখোলের দক্ষতা তুলনাহীন। পাখিবিদ ড. জার্ডন একটা শামখোলের চোখ বেঁধে তার সামনে পানিতে শামুক দিয়ে প্রমাণ পেয়েছিলেন যে, কিছু দেখতে না পেলেও পাখিটি অনায়াসে শামুক ভেঙে খেতে পারে। তবে একই পদ্ধতিতে সে ঝিনুক ভাঙতে পারে না। শামখোল পাখি ঝিনুক তুলে এনে রোদে রাখে। কিছুক্ষণ রোদে থাকলে ঝিনুক আপনি খুলে গিয়ে শামখোলের সুইট-ডিশ হয়ে যায়।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্ল্যান্ট-প্রোটেকশন নামে এক অদূরদর্শী প্রকল্প এ দেশের বিল-বাঁওড়ে বিমান উড়িয়ে ডিডিটি ছিটিয়েছিল। তার ফলে কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, উভচর, পাখি ও মাছের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। শামুক-ঝিনুকও বিষাক্ত হয়ে পড়ে এবং শামখোল মরতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির প্রভাব নিয়ে ‘নীরব বসন্ত’ শিরোনামে অবিস্মরণীয় এক বই লেখেন বিজ্ঞানী র্যাচেল কার্সন। এর ফলে ডিডিটি-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং ভয়ংকর কীটনাশকটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
ডিডিটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর ব্যবহার কমে গেলেও এ দেশে ব্যবহৃত ক্ষতিকর কীটনাশকের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। স্টর্ক, ক্রেইন, র্যাপ্টর ইত্যাদি পরিবারের অনেক প্রজাতির বড় আকারের পাখির সংখ্যা ক্রমাগত কমে গেছে, আজও কমেই চলেছে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম শামখোল পাখি। বিলুপ্তির স্টিম রোলারের সামনে থেকে এই একটি পাখি সরে আসতে সক্ষম হয়েছে।
এ দেশের অনেক ধানখেতেই আমরা এখন শামখোলের ঝাঁক দেখতে পাই। ইরি ধানের খেতে পানি জমা থাকে বলে এখানে শামুকের বাড়বাড়ন্ত হয় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে নেমে পড়ে শামুকভুক এই পাখির দল। অনুমান করি, বিলুপ্তির দ্বার থেকে শামখোল পাখিকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দেশব্যাপী ইরি চাষেরও কিঞ্চিৎ অবদান রয়েছে।