প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেছেন, ‘সাবেক পুলিশপ্রধান (বেনজীর আহমেদ) ও সাবেক সেনাপ্রধানের (আজিজ আহমেদ) দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরিভাগমাত্র, এ কথা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনই বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিলসমাধি হবে’।
সোমবার (২৪ জুন) সংসদ অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় ‘দুর্নীতির মচ্ছব’ বন্ধ করতে এখনই বিশেষ কমিশন গঠন, দুর্নীতিবাজদের অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং ঋণখেলাপি, অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার দাবি জানান রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, বিএনপি আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ-পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দেশ এখন সে কলঙ্ক থেকে মুক্ত হলেও এখনো শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির যে চিত্র সম্প্রতি বেরিয়ে আসছে, তা দেশের ভাবমূর্তি কেবল নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা সৃষ্টি করছে। দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়শনের দেওয়া বিবৃতিরও সমালোচনা করেন এই প্রবীণ রাজনীতিক। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য, আমরা এখানে দেখলাম, পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিকদের ধমক দেওয়া হয়েছে।’
ঝালকাঠির সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে মেনন বলেন, এই দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ-মাদক চোরাচালানি ও অপরাধজগতের যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, তাতে সংসদ সদস্য ও সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখে সরকারকে আত্মসমালোচনার পরামর্শও দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর প্রসঙ্গে মেনন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি কোথায় গেল, আমরা জানি না। তিস্তার পানি চুক্তি না করে এই সহযোগিতা গাছের গোড়া কেটে ওপর দিয়ে পানি ঢালার শামিল। এই সফরে গঙ্গা চুক্তির নবায়নের কথা এসেছে। কিন্তু গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সংকোশ নদী থেকে খাল কেটে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির যে বিষয়টি ছিল, তা ৩০ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি; বরং এখন ফারাক্কার ওপরে আরেকটি ব্যারেজ তৈরির কথা এসেছে। তিস্তা নিয়ে যেন আমরা ভূ-রাজনীতির দ্বৈরথের শিকার না হই। প্রয়োজনে পদ্মা সেতুর মতো নিজেদের অর্থায়নে তিস্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরামর্শও দেন তিনি।
কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘নিষ্ঠুর অলিগার্কিরা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। লুটের টাকাকে যখন সাদা করার জন্য সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের চেয়ে অর্ধেক কর দিয়ে সাদা করার প্রস্তাব করা হয়, তখন সেটা সততার জন্য তিরস্কার ও অসততার জন্য পুরস্কারের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা কেবল অসারই নয়, এ প্রসঙ্গে সরকারের অতীত অবস্থানের বিপরীত। খালেদা জিয়ার জন্য যেটা অনৈতিক, বর্তমানেও সেটা অনৈতিক।’ বলেও মন্তব্য করেন রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেন, সেই অলিগার্কির স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে’।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি ইনস্টিটিউশনের তথ্য অনুযায়ী বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের আধুনিক শপিং মল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ‘ব্যাংক কমিশন’ গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরের অর্থমন্ত্রী তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর এখন ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তুঘলকি কাণ্ড করছে।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম মামলা–জট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। ঝিনাইদহ-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সালাহ উদ্দিন মিয়াজী বলেন, তার নির্বাচনি এলাকা সীমান্তবর্তী। তারকাঁটাবিহীন প্রায় ১৭ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে সোনা চোরাচালান, নারী-শিশু পাচার ও মাদকদ্রব্যের চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। এসব তৎপরতা বন্ধে তিনি জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনীকে সমন্বয় করে একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারে প্রতি আহ্বান জানান।
এলিস/এমএ/