সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে- বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মানে গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার বৃদ্ধির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না পেয়ে বেকারত্ব বাড়ার খবরটি আমাদের সামনে খুব আসে। সত্যিকার অর্থে, দেশে এখন বেকার লোক কত, তা সঠিকভাবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। আজকে আমি বেকারত্বের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়-বিষয়ক কিছু কথা লিখতে চাই। আর এ বিষয়ের সঙ্গে বেকারত্ব দূরীকরণের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ মানবসম্পদের অভাব বোধ করে থাকে। এ বিষয়ে একটি পরিসংখ্যান দিতে পারলে ধারণাটি নিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যাবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ওই প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। কয়েক বছর আগেও বিশ্বব্যাংক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল।
তাতেও দেখা গেছে, স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যারা তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপেও দেখা যায়, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি, যেখানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। অন্যদিকে দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশকে বেকার হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। এই হার কিছুটা জ্যামিতিক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা যদি শুধু উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গেই কথা বলি, তাহলে প্রথমেই উচ্চশিক্ষার প্রধানতম উদ্দেশ্যের কথা বলা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষার প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে: ১. প্রচলিত জ্ঞানের বিকাশ সাধন, ২. সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা এবং এর প্রকৃত কারণ শনাক্ত করা, ৩. সীমিত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে ওই সমস্যার সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমাধান খুঁজে বের করা, এবং ৪. বিভিন্ন বিশেষায়িত খাতের প্রয়োজন অনুযায়ী পেশাগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওই খাতের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা।
এই লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক সমন্বয় করা যেতে পারে। বর্তমান বাস্তবতায় বেকারত্ব দূরীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের গুরুত্ব বেড়েছে।
বর্তমান সরকার এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই পদ্ধতিগতভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার কিছু দৃশ্যমান ফলাফল আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখতে পাচ্ছি।
প্রতিবছর অসংখ্য চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে অনেকেই দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পাচ্ছেন। অনেকেই আছেন যারা মেধা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে স্বউদ্যোগে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তবে চাকরির ক্ষেত্রে যারা যথাযথ দক্ষতা তৈরি করতে পারছেন না, তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পছন্দের তালিকায় নিতে পারছে না। ফলে একটি বড় অংশ প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পরামর্শ দেন।
তবে যেসব শিক্ষার্থী চাকরিকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান তাদের জন্য বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় জরুরি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা যথেষ্ট গঠনমূলক এবং সমন্বয়সম্পন্ন হওয়ার প্রসঙ্গটি সর্বাগ্রে। বিশেষ করে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক জনশক্তি তৈরিতে কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমন্বয় অনেক জরুরি। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে প্রচলিত জ্ঞানের পাশাপাশি ‘নতুন জ্ঞান’ সৃষ্টি করা।
পুরনো বই কিংবা নোট মুখস্থ করে পরীক্ষায় তা লেখা- এক ধরনের একাডেমিক ‘চৌর্যবৃত্তি’। এই মুখস্থ বিদ্যার চর্চা তথা চৌর্যবৃত্তি দেশের উন্নয়নের কিংবা নতুনত্বের সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। অন্যদিকে শিক্ষকদের যে ধরনের পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার এবং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা তৈরিতে যেসব প্রচেষ্টা থাকা আবশ্যক সেগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমন্বয়হীনতা রয়েছে। শিক্ষকগণও যদি পুরনো তথ্য নিয়ে ক্লাসে যান অথবা ১০-১৫ বছর আগের তৈরিকৃত নোট নিয়ে শিক্ষাদান অব্যাহত রাখেন সেটির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে বাধা তৈরি হয়।
আর সে জন্যই নিয়োগকর্তাদের প্রায়ই অভিযোগ করতে শোনা যায়, আমাদের গ্রাজুয়েটরা বাজার চাহিদা অনুযায়ী আউটপুট দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে বেকারত্বের উচ্চহারের যে সহসম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে যেভাবে গবেষণায় উঠে আসছে, তা সম্ভবত উচ্চশিক্ষায় আমাদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরাতন গতানুগতিক কারিকুলামের ফলেই।
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কীভাবে আউটকামভিত্তিক কারিকুলাম প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা যায় সে লক্ষ্যে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সফলতা আসতে একটু সময় লাগলেও প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার প্রসঙ্গটি অনেকটা আশার আলো দেখায়। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই উচ্চশিক্ষা ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের একাগ্রতা, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা আর দায়িত্ববোধ দিয়ে যথাসময়ে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে নিজের বেকারত্বের অবসান ঘটাতে পারেন। শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের বেকারত্বের অবসান ঘটাতে পারেন। আর এতেই উচ্চশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক বেকারত্বের হার কমতে থাকবে।
আমাদের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নিঃসন্দেহে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সহজেই কোনো একটি নির্দিষ্ট পেশায় ঢুকে পড়ার ভালো সুযোগ তৈরি হয়।
আমরা যদি বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিশালী রাষ্ট্র চীনের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম প্রণয়নে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট অবদান এবং সমন্বয় রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সেই অর্থে গড়ে উঠছে না। আর এ কারণে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনশক্তি গড়ে তুলতে পারছে না বলে অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় যত বৃদ্ধি করা যাবে ততই বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]